রক্তস্বল্পতা বা এনেমিয়া দূরকরে যেসব খাবার
প্রতিদিন আয়রনযুক্ত ফল যেমন আপেল, টমেটো, বেদানা, কলা, আঙ্গুর, কমলা, গাজর ইত্যাদি খেলে রক্তশূন্যতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই সরাসরি আয়রন গ্রহণ করতে প্রতিদিন ২-৩ টি ফল খেতে ভুলবেন না। শাক সবজিতেও প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে।
রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কম থাকলে তাকে রক্তস্বল্পতা বা রক্তশূন্যতা বা এনেমিয়া বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে অনেক মানুষ রক্তস্বল্পতা রোগে ভোগে। বিশেষ করে যারা পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত তাদের রক্তস্বল্পতার প্রবণতা বেশি হয়। রক্তস্বল্পতা রোগের চিকিৎসার জন্য প্রথমে পরিবর্তন আনতে হবে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়। যেসব খাবারের রক্তস্বল্পতা দূর করার ক্ষমতা রয়েছে সেসব খাবার খেতে হবে নিয়মিত।
তবে রক্তাল্পতা রোধের জন্য নিয়মিত আমলার জুস ও লাল বিটরুটের জুস খাওয়ার অভ্যেস গড়তে পারেন। এই উপকারী জুসের কারণে রক্তের মধ্যে তাজা অক্সিজেন সরবরাহ হয়। এছাড়া প্রতিদিন একটি করে আপেল খেলে অ্যানিমিয়ার প্রকোপ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
রক্তস্বল্পতা হলে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে, কর্মক্ষমতা লোপ পায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই রক্তশূন্যতায় খাবারের দিকে বেশি খেয়াল রাখতে হবে। শুধু মাত্র পুষ্টিকর কিছু খাবার খেয়েই রক্তশূন্যতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
আসুন জেনে নেয়া যাক রক্তশূন্যতা দূর করে এমন কিছু পুষ্টিকর খাবার সম্পর্কে:
কলিজা: কলিজায় প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও ভিটামিন বি আছে। রক্তস্বল্পতা রোগের প্রধান কারণ দেহে আয়রনের ঘাটতি। তাই রক্তশূন্যতায় ভুগছেন যারা তাদের নিয়মিত খাবার তালিকায় সম্ভব হলে কলিজা রাখা উচিত। খাসি বা গরুর কলিজায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। তবে যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদের অবশ্যই গরুর কলিজা থেকে দূরে থাকতে হবে।
দুধ: দুধ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও প্রোটিন যোগাতে সাহায্য করে। দুধে খুব বেশি পরিমাণে আয়রন না থাকলেও এতে প্রায় সব রকমের ভিটামিন আছে। এছাড়াও দুধে আছে পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম। এই খাদ্য উপাদানগুলো রক্তের হিমোগ্লোবিন বাড়িয়ে রক্তশূন্যতা দূর করতে সহায়তা করে। তাই রক্তশূন্যতার রোগীদের জন্য নিয়মিত দুধ খাওয়া উপকারী।
মাছ: আয়রনের ভাল উৎস হল মাছ, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ। তাছাড়া ছোট মাছ যেমন-শিং মাছ, টেংরা মাছ ইত্যাদি সব মাছেই রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। তাই রক্তস্বল্পতা রোগ থেকে দেহকে মুক্ত রাখতে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় মাছ রাখুন।
ফলমূল: ফলমূলে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। প্রতিদিন আয়রনযুক্ত ফল যেমন আপেল, টমেটো, বেদানা, কলা, আঙ্গুর, কমলা, গাজর ইত্যাদি খেলে রক্তশূন্যতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই সরাসরি আয়রন গ্রহণ করতে প্রতিদিন ২-৩ টি ফল খেতে ভুলবেন না।
খেজুর: খেজুরের পুষ্টিগুণ বলে শেষ করা যাবে না। খেজুরে রয়েছে ভরপুর আয়রন। তাই রক্তস্বল্পতার সমস্যা দূর করতে নিয়মিত খাদ্যতালিকায় খেজুর রাখতে পারেন।
টমেটো: টমেটো রক্তস্বল্পতা দূর করতে খুবই কার্যকরী উপাদান। টমেটোয় থাকা আয়রন, ভিটামিন ‘সি’ ও লাইকোপেন রক্তাস্বল্পতাসহ নানা রোগের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে সক্ষম। তাই নিয়মিত খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন টমেটো
চীনাবাদাম: রক্তাস্বল্পতার হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে রোজ চীনাবাদাম খান। চীনাবাদামে থাকা আয়রন আপনার শরীরকে রাখবে নিরাপদ।
শাক সবজি: শাক সবজিতেও প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে। বিভিন্ন রকম সবজি, যেমন কচু শাক, কচুর লতি, কচু, পালং শাক, বিট, লেটুস, ব্রকোলি, ধনিয়া পাতা এবং পুদিনা পাতা নিয়মিত খেলে রক্তশূন্যতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কারণ এই শাক সবজিগুলোতে আয়রনের পাশাপাশি ফলিক এসিড আছে যেগুলো রক্তের হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।
ডাল: রক্তস্বল্পতা দূর করতে প্রতিদিন মসুর, মুগ কিংবা মাসকলাইয়ের ডাল খেতে পারেন। কারণ এই খাবারগুলিতে প্রচুর ফোলেট পাওয়া যায়। ফোলেট রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে। তাই আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ফোলেটসমৃদ্ধ খাবার রাখা অত্যন্ত জরুরি।
ডিম: ডিমের মধ্যে রয়েছে প্রোটিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। রক্তস্বল্পতা কমিয়ে শরীরে রক্তের পরিমাণ বাড়াতে ডিম খুব উপকারী। ডিমের কুসুমের মধ্যে রয়েছে আয়রন। এটি শরীরে লোহিত রক্তের কণিকার পরিমাণ বাড়ায়।
ভিটামিন সি জাতীয় ফল: আমাদের দেহে রক্তকোষ তৈরিতে ভিটামিন সি জাতীয় যে কোন ফল এর উপকারিতা অনেক বেশি। তাই প্রতিদিন ভিটামিন সি জাতীয় ফল খাওয়া উচিত দেহের রক্তশূন্যতা দূর করার জন্য।
মধু: মধু আয়রনের একটি ভালো উৎস। আয়রন ছাড়াও মধুতে কপার ও ম্যাঙ্গানিজ আছে। এই উপাদানগুলো শরীরে হিমোগ্লোবিন প্রস্তুত করতে সহায়তা করে। তাই রক্তশূন্যতা দূর করতে প্রতিদিন ১ চামচ মধুর সাথে পরিমাণগত লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন।
সয়াবিন: সয়াবিনে রয়েছে উচ্চমাত্রায় আয়রন এবং ভিটামিন। এর মধ্যে থাকা সাইটিক এসিড রক্তস্বল্পতার সঙ্গে লড়াই করে। সয়াবিনের রয়েছে কম পরিমাণ চর্বি ও অধিক পরিমাণে প্রোটিন। প্রোটিনও এনিমিয়া প্রতিরোধে উপকারী।
সাধারণত মেয়েরা রক্তস্বল্পতার সমস্যায় বেশি ভোগেন। শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে রক্তশূন্যতা হয়। এই খাবারগুলি আয়রনে পরিপূর্ণ যা রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
জেনে নিন রক্তস্বল্পতা হলে কি কি শারীরিক সমস্যা হয়:
দুর্বলতা, মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, চোখে অন্ধকার দেখা, অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে ওঠা, বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঝিমঝিম করা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, কাজকর্মে অনীহা, অনিদ্রা, অল্পতে মনোযোগ নষ্ট হওয়া, জিহ্বা ও ঠোঁট মসৃণ ও সাদাটে হয়ে যাওয়া, মুখের কোনায় ও জিহ্বায় ঘা হওয়া, নখে ভঙ্গুরতা বা চামচের মতো গর্ত হওয়া, অরুচি, বমি বমি ভাব, হজমে ব্যাঘাত ঘটা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
যেসব অভ্যাস বদলাতে হবে
১. খাবার খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে–পরে চা, কফি, কোনো কোমল পানীয় খেলে খাবারের আয়রন শরীরে ঠিকভাবে শোষিত হতে পারে না। তাই অভ্যাস বদলে ফেলুন।
২. খালিপেটে ফল খাবেন না। ফলের ভিটামিন সি খাবারের আয়রনকে শোষিত হতে সাহায্য করে।
৩. ইসবগুল খান খাবার খাওয়ার ঘণ্টা দুয়েক আগে বা পরে। না হলে ফাইবারের ছাঁকনিতে পুষ্টির বেশ কিছুটা আটকে যেতে পারে।
৪. জাঙ্ক ফুড হল মুখরোচক খাবার হলেও কোনো পুষ্টিগুণ নেই। এছাড়া বেশি খেয়ে পেটের গোলমাল হলে আরেক সমস্যা।
৫. মাছ, মাংস ও ডিম খাওয়ার পর দুধের খাবার খাওয়া ঠিক নয়।
৬. রেড মিট, মাছ বিশেষ করে কুচো চিংড়ি, ডিম, মেটে ইত্যাদিতে আছে হিম–আয়রন। যা সহজে শরীরের কাজে লাগে। আর দুধ ও দুধে তৈরি খাবার, সবুজ শাক-সব্জি, মুসুর ও অন্যান্য ডাল, বিন, পাস্তা, ফল, বাদাম, ফর্টিফায়েড ব্রেকফাস্ট সিরিয়ালে থাকে নন–হিম আয়রন, যা সহজে শোষিত হতে পারে না।
তবে সঙ্গে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন- লেবু, কমলা, আমলকী বা অন্য টক ফল খেলে শোষণের হার বাড়ে।