পুরুষের প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি
পুরুষের প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি সর্ম্পকে প্রথমআলো পত্রিকায় লিখেছেন ডা. আরমান রেজা চৌধুরী কনসালট্যান্ট, রেডিয়েশন অনকোলজি, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা।
প্রোস্টেট ক্যানসার পুরুষদের একটি বিশেষ ক্যানসার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ২০২০ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার পুরুষের। বাংলাদেশে ক্যানসারের রোগীদের মধ্যে ১ দশমকি ৬ শতাংশ রোগী প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত।
প্রোস্টেট ক্যানসার
পুরুষের মূত্রথলির নিচে প্রোস্টেট নামের একটি গ্রন্থি থাকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রোস্টেট গ্রন্থি আকারে বৃদ্ধি পায়। তবে সব বর্ধিত প্রোস্টেট থেকেই ক্যানসার হয় না। বেশির ভাগই হলো বিনাইন অ্যানলার্জমেন্ট অব প্রোস্টেট, অর্থাৎ তা ক্যানসার নয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রোস্টেট গ্রন্থিতে ক্যানসার হতে পারে।
প্রোস্টেট ক্যানসারের প্রকৃত কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে কয়েকটি বিষয় এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পুরুষের বয়স। সাধারণত যাঁদের বয়স ৫০ বছরের বেশি, এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তাঁদেরই বেশি। এ ছাড়া পারিবারিক ইতিহাস বা জেনেটিক কারণ এই ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধ
যেহেতু প্রোস্টেট ক্যানসারের প্রকৃত কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি, কাজেই এ রোগের প্রতিরোধের উপায় সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা কঠিন। তবে সম্ভাব্য কারণ ও ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক হলে বা এড়িয়ে চললে উপকার পাওয়া সম্ভব। যেমন ধূমপান বর্জন, আমিষ ও চর্বিজাতীয় খাবার পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ, খাদ্যতালিকায় গাজর, টমেটো, ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি–সমৃদ্ধ খাবার প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। প্রোস্টেট ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে ৪০ পেরোলেই অথবা কোনো লক্ষণ অনুভব করলেই দেরি না করে যথাযথ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ও নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করানো উচিত। প্রোস্টেট গ্রন্থির প্রদাহ হলে হেলাফেলা না করে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নেওয়া উচিত। কোনো প্রয়োজনে বাইরে থেকে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরন শরীরে প্রবেশ করাতে হলে তার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
প্রোস্টেট ক্যানসারের লক্ষণ
৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণ থাকে না। অত্যন্ত ধীরগতিতে বাড়ার কারণে প্রোস্টেট ক্যানসার শরীরে দানা বাঁধার অনেক দিন পর্যন্ত কোনো ধরনের লক্ষণ অনুভূত হয় না। তবে ধীরে ধীরে প্রোস্টেট ক্যানসার বড় হয়ে গিয়ে যখন মূত্রনালিকে আক্রান্ত করে, তখন বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যায়। এর মধ্যে প্রস্রাবের গতি কমে যাওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাবের চাপ হলে প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা, প্রস্রাব সম্পূর্ণভাবে না হওয়া বা অসম্পূর্ণ প্রস্রাব নির্গত হওয়া অনুভূত হওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, বীর্যের সঙ্গে রক্ত যাওয়া উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া এই ক্যানসার আরও বেশি বেড়ে গেলে মেরুদণ্ডের হাড়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তখন হাড়ে ব্যথা অনুভূত হয়, কখনো কখনো আক্রান্ত হাড় ভেঙেও যেতে পারে।
এখানে বলে রাখা ভালো, এসব উপসর্গ দেখা দিলেই যে প্রোস্টেট ক্যানসার হয়েছে, এমনটি ভাবাও ঠিক নয়। কারণ, প্রোস্টেট ক্যানসার ছাড়াও আরও অনেক অসুখে এমন উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রোস্টেট ক্যানসার নির্ণয়ের পদ্ধতি
সাধারণত পিএসএ বা প্রোস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করে প্রোস্টেট ক্যানসার নির্ণয় করা হয়। এ ছাড়া ডিজিটাল রেকটাল এক্সামিনেশন (ডিআরই) করে প্রোস্টেট ক্যানসার এবং এর আশপাশের বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন চিকিৎসক। ট্রানসরেকটাল আলট্রাসনোগ্রাফি, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় টিআরইউএস, এর মাধ্যমে আরও ভালোভাবে প্রোস্টেট ক্যানসারের ছবি দেখা যায় এবং এই ছবিতে প্রোস্টেট গ্রন্থিতে সন্দেহজনক কোনো টিউমার পাওয়া গেলে সেখান থেকে বায়োপসি করে টিস্যু নিয়ে মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করে প্রোস্টেট ক্যানসার নিশ্চিত করা হয় এবং এর ধরন সম্পর্কেও জানা যায়। এ ছাড়া ক্যানসার নির্ণীত হলে আরও কিছু পরীক্ষা, যেমন সিটি স্ক্যান, এমআরআই, ফুল বডি আইসোটোপ বোন স্ক্যান, পিএসএমএ স্ক্যানের মাধ্যমেও প্রোস্টেট ক্যানসারের পর্যায় নির্ধারণ করা হয়। পর্যায় নির্ধারণ করার পরই মূলত পর্যায় অনুযায়ী প্রোস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসা করা হয়।
চিকিৎসা
প্রোস্টেট ক্যানসারে অস্ত্রোপচার বা রেডিক্যাল প্রস্টেটেকটমি, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি—সব কটিরই ভূমিকা রয়েছে। এর মধ্যে কোনটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করে ক্যানসারের পর্যায়ের ওপর। তবে সঠিকভাবে নিয়মিত চিকিৎসা করাতে পারলে প্রোস্টেট ক্যানসারের রোগী দীর্ঘদিন ভালো থাকতে পারেন। বাংলাদেশেই প্রোস্টেট ক্যানসারের সব ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি সহজলভ্য।
কাজেই কোনো ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পেলে বা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে প্রোস্টেট ক্যানসার ধরা পড়লে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।