করোনার ধরন যা–ই হোক, হতে হবে সচেতন
করোনার ধরন ও সচেতনতা সর্ম্পকে প্রথমআলো পত্রিকা লিখেছেন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও কোভিড-১৯–বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার বিষয় হলো করোনার ‘ভারতীয় ভেরিয়েন্ট’ আর ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক। এ নিয়ে আছে নানা ধরনের আতঙ্ক, আর অমূলক সন্দেহও। এদিকে সীমান্ত এলাকায় সংক্রমণের হার বাড়ছে। ভারতীয় ধরন পাওয়া যাচ্ছে অনেকেরই রক্ত পরীক্ষায়। জুনের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে সংক্রমণের একটা উল্লম্ফনের আশঙ্কা করছেন গবেষকেরা। এ অবস্থায় আপনার-আমার করণীয় কী?
ভারতীয় ধরন নিয়ে ভাবনা
ভারতের ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণ হিসেবে শনাক্ত হয়েছে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের নতুন এক ধরন বি.১.৬১৭। এর আবার তিন রকমের সাব–ভেরিয়েন্টও (উপধরন) শনাক্ত করেছেন সে দেশের বিজ্ঞানীরা, যার মধ্যে ক্রমে অন্যতম প্রধান হয় উঠেছিল বি.১.৬১৭.২, যা গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথম শনাক্ত হয় আর এ বছর মার্চে ভারতে তাণ্ডব চালাতে শুরু করে। ইতিপূর্বে আতঙ্ক সৃষ্টি করা যুক্তরাষ্ট্রের ধরনের চেয়েও এটি বেশি দ্রুত ছড়ায় বলে গবেষকেরা বলেছেন।
এ ধরনটির বিশেষত্ব হলো যেকোনো বয়সের মানুষকেই দ্রুত সংক্রমিত করা আর অক্সিজেন স্যাচুরেশন দ্রুত কমে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করা। তবে এটি যে অন্য ধরনের চেয়ে বেশি ঘাতক, তা এখনো প্রমাণিত হয়নি।
সঠিক স্বাস্থ্যবিধি পালনের মাধ্যমে আর সব ধরনের মতো ভারতীয় ধরনও প্রতিহত করা যায়। চিকিৎসাব্যবস্থাও আর সব ধরনের মতোই। সঠিক সময়ে শনাক্ত করা, সঠিক সময়ে অক্সিজেন সরবরাহ এবং অন্যান্য চিকিৎসা পেলে সুস্থ হওয়া সম্ভব। এমনকি গবেষকেরা এও দেখেছেন যে ফাইজার ও অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা এই ধরনের বিপরীতেও কার্যকর।
তাই ভারতীয় ধরন নিয়ে অতি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, আবার নিশ্চিন্তে বসে থাকাও চলবে না। কারণ, দ্রুত সংক্রমণ ছড়ায় বলে ধরন একই সঙ্গে একটি এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষকে যখন সংক্রমিত করে ফেলবে, তখনই দেখা দেবে হাসপাতালে শয্যা ও অক্সিজেনসংকট, চিকিৎসক ও নার্সসংকট। চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, ফলে বাড়বে মৃত্যু। কারণ, এত বিপুল জনগণকে একসঙ্গে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সামর্থ্য বা অবকাঠামো অনেক উন্নত দেশেরও নেই, যে জন্য ভারতে আমরা অবর্ণনীয় এক শোকাবহ পরিস্থিতি ঘটতে দেখেছি। এরই মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত জেলাগুলোয় সংক্রমণ বাড়ছে আর হাসপাতালের শয্যা ও অক্সিজেনসংকট বাড়তে শুরু করেছে।
বাংলাদেশে এ মুহূর্তে করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ একটু কম মনে হলেও তাই নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই। সীমান্ত এলাকায় সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে এটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই এখনই সতর্ক হতে হবে। যেকোনো ধরনকে প্রতিহত করতে পারে সঠিক নিয়মে পরা ভালো মানের মাস্ক। তাই বাইরে যেতে হলে অবশ্যই ভালো মানের মাস্ক পরুন, সম্ভব হলে দুটি মাস্ক পরুন। গরম, ঘাম ইত্যাদি কারণে মাস্ক পরতে সমস্যা হয়—এই অজুহাতে কখনোই মাস্ক খুলবেন না। ঘেমে গেলে মাস্ক পরিবর্তন করুন, সারা দিনের জন্য কাজে বের হলে বাড়তি মাস্ক বহন করুন।
সেই সঙ্গে ভিড় এড়িয়ে চলুন, দূরত্ব বজায় রাখুন। প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবেন না। অকারণ ভ্রমণ করবেন না। এত দিন রাজধানী ও বড় শহরে কাজে আসা মানুষ সংক্রমণ নিয়ে বাড়ি ফিরে যেত, এখন উল্টো। এখন দূরের জেলা শহর থেকেই সংক্রমণ নিয়ে আসতে পারেন রাজধানীতে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউন দেওয়া হলেও সীমান্তের অন্যান্য জেলার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়নি। অচিরেই সারা দেশে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।
আতঙ্কের নাম কালো ছত্রাক
ভারতীয় ধরনের সঙ্গে নতুন আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস। সম্প্রতি ভারতে এই ছত্রাক সংক্রমণের হার বেড়ে গেছে আর মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন কিছু নয়, এই ছত্রাক আমাদের আশপাশের আর্দ্র ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ আর পচনশীল ফলমূল সবজি বা খাবারেই থাকে। এর স্পোর বাতাসে উড়ে বেড়ায় আর নাক দিয়ে আমাদের দেহে প্রবেশ করতে পারে। কখনো ত্বকের কাটা–ছেঁড়া অংশ দিয়েও শরীরে প্রবেশ করে। তবে স্বাভাবিক অবস্থায় এটি কোনো সংক্রমণ ঘটায় না। কারণ, আমাদের সাধারণ রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা একে নিষ্ক্রিয় করে দিতে সক্ষম। কিন্তু যেসব কারণে ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধব্যবস্থায় ফাটল ধরে, যেমন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, ক্যানসার বা কিডনি প্রতিস্থাপনের রোগী, কেমোথেরাপি বা উচ্চমাত্রার স্টেরয়েড পাচ্ছে এমন ব্যক্তি, এইচআইভিতে আক্রান্ত, অপুষ্টির শিকার ব্যক্তির জন্য এই ছত্রাক ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোভিড–১৯।
করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির এমনিতেই ইমিউনিটি কমে যায়, তার ওপর দীর্ঘ রোগভোগ, স্টেরয়েডের ব্যবহার, সঙ্গে ডায়াবেটিস ও অন্যান্য জটিলতা এদের ছত্রাক সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। অপরিশোধিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন ব্যবহারকেও দায়ী করা হচ্ছে। সাধারণত দেখা যায় করোনা থেকে সেরে ওঠার সময়, মানে সংক্রমণের ১২-১৮ দিনে এ ধরনের সংক্রমণ বেশি হয়।
কেবল ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নয়, আরও নানা ধরনের সুযোগসন্ধানী জীবাণু করোনা হলে মাথাচাড়া দিতে পারে। যেমন: হোয়াইট ফাঙ্গাস, ইয়েলো ফিভার, ক্যানডিডা ছত্রাক—প্রস্রাবের বা কান, নাক, মুখ, দাঁতের নানা সংক্রমণ দেখা দেয় রোগীদের মধ্যে। বিশেষ করে যাঁরা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) দীর্ঘদিন থাকেন বা দীর্ঘদিন স্টেরয়েড পান।
মিউকরমাইকোসিস নাক দিয়ে প্রবেশ করলে সাইনোসাইটিসের মতো উপসর্গ, মুখ বা চোখের একপাশ ফুলে যাওয়া, সর্দি, নাক দিয়ে তরল নিঃসরণ, চোখের পাতা ফুলে যাওয়া, দৃষ্টির সমস্যা হতে পারে। ফুসফুস সংক্রমিত হলে শ্বাসকষ্ট, কফের সঙ্গে রক্ত; পাকস্থলী সংক্রমিত হলে বমি, ডায়রিয়া; মস্তিষ্ক আক্রান্ত হলে অসংলগ্ন আচরণ, মাথাব্যথা, বমি এমনকি অচেতন হতে পারে। হোয়াইট ফাঙ্গাস যকৃৎ ও কিডনিকে আক্রান্ত করতে পারে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের চিকিৎসা যেমন ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি, তেমনি এর জটিলতাও অনেক। তাই এর প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। সবচেয়ে ভালো হচ্ছে করোনা যেন না হয় সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। তাই পরবর্তী ঢেউ বা আসন্ন দুর্যোগ ঠেকাতে এখনই সচেতন হতে হবে।
সতর্কতা
- ব্ল্যাক ফাঙ্গাসসহ করোনার নানা জটিলতা ঠেকাতে করোনা ছাড়াও কো মরবিড কন্ডিশন বা সহযোগী রোগগুলোর চিকিৎসার দিকে নজর দিতে হবে। যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি বা হৃদ্রোগের সুচিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ করা।
- ইমিউনিটি বাড়াতে সঠিক পুষ্টি, ধূমপান বর্জন, নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটা, পর্যাপ্ত ঘুম এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হন।
- যাঁরা কোভিড বা অন্য রোগের কারণে স্টেরয়েড সেবন করেন, তারা বিশেষভাবে সতর্ক থাকবেন। ডায়াবেটিস ও বার্ধক্যজনিত রোগ থাকলে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
- যেকোনো ধরন প্রতিরোধে সঠিকভাবে মাস্ক পরুন, মাস্ক খুলবেন না বা গলায় ঝুলিয়ে রাখবেন না। ভিড় এড়িয়ে চলুন। অকারণে বাইরে যাবেন না।
- বাসি–পচা খাবার, উচ্ছিষ্ট কখনো খাবেন না। নোংরা–অপরিচ্ছন্ন জায়গায় খালি পায়ে হাঁটবেন না। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও হাইজিন বজায় রাখুন। ধুলাবালু ও বায়ুদূষণ এড়িয়ে চলুন। শরীরে কোথাও কেটে–ছিঁড়ে গেলে তা পরিষ্কার রাখুন।
- জ্বরসহ যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।