বর্ষাকালে পানিবাহিত রোগ
বর্ষাকালে পানিবাহিত রোগ সর্ম্পকে প্রথমআলো পত্রিকা লিখেছেন ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন সহযোগী অধ্যাপক, পরিপাকতন্ত্র, লিভার ও প্যানক্রিয়াস রোগ বিভাগ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা।
ঋতু পরিক্রমায় এখন বর্ষাকাল। স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। নদ-নদী, খাল-বিল পানিতে পরিপূর্ণ। শহরেও জলাবদ্ধতা। হয়তো দেশের অনেক জায়গায় বন্যা দেখা দেবে। বর্ষাকালে বিশেষ করে বন্যা উপদ্রুত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট তৈরি হয়ে থাকে। শহরে ওয়াসার পানি হয়ে পড়ে দূষিত। চারদিকে দেখা যায় নানা পানিবাহিত রোগ (যেমন: টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, ডায়রিয়া, জন্ডিস প্রভৃতি)।
এসব পানিবাহিত রোগ সাধারণত দূষিত পানি ও জীবাণুযুক্ত খাবার থেকেই হয়ে থাকে। প্রতিবছর এই মৌসুমে দেশজুড়ে দেখা দেয় ডায়রিয়া ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগের প্রকোপ। অনেক মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়। অথচ একটু সতর্কতা অবলম্বন করলে কিন্তু আমরা এসব রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারি।
টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েড
সালমোনেলা টাইফি ও প্যারা টাইফি নামের দুটো ব্যাকটেরিয়া দিয়ে এ দুটি রোগ হয়ে থাকে। রোগীর প্রচণ্ড জ্বর, পেটব্যথা, পায়খানার সমস্যা, মাথাব্যথা প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়। সময়মতো টাইফয়েডের চিকিৎসা খুব জরুরি। কারণ, যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা না করা গেলে পায়খানার সঙ্গে রক্তপাত এমনকি নাড়ি ফুটো হয়ে রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে শরীরের নানা জায়গায়। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে টাইফয়েড রোগ নির্ণীত হলে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক অনেক সময় শিরাপথে দিতে হয়। সঙ্গে বিশ্রাম ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়। কারও উচ্চমাত্রার জ্বর সাত দিনের বেশি চলমান থাকলে টাইফয়েড হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ডায়রিয়া
বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও প্রোটোজোয়া দিয়ে ডায়রিয়া হয়ে থাকে। রোগীর পাতলা পায়খানার সঙ্গে বমি, পেটব্যথা এমনকি জ্বর হতে পারে। কখনো মলের সঙ্গে রক্তপাত বা আমাশয় ও পেট কামড়ানো হতে পারে। পানির মতো তরল ও সাদা পায়খানা হলে কলেরা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
ডায়রিয়ার মূল চিকিৎসা পানিশূন্যতা রোধ করা। সময়মতো পানিশূন্যতা রোধ করতে না পারলে রক্তে খনিজ লবণের ঘাটতি ও কিডনি সংক্রমণের মতো মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। ডায়রিয়া হলে বারবার তাই মুখে খাওয়ার স্যালাইন খেতে হবে। যদি তীব্র পানিশূন্যতা থাকে আর স্যালাইন বমি হয়ে যায়, তবে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে শিরায় স্যালাইন দিতে হবে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দরকার হয়, নয়তো বেশির ভাগ ডায়রিয়া এমনিতেই সেরে যায়।
জন্ডিস
হেপাটাইটিস এ ও হেপাটাইটিস ই—এ দুটি ভাইরাস পানি বা খাবারবাহিত সংক্রমণ তৈরি করে। আর এই কারণে জন্ডিস হতে পারে। রোগীর চোখ ও শরীর হলুদ হয়ে যায়। প্রস্রাবের রং গাঢ় হলুদ হয়ে যায়। তা ছাড়া খাবারে অনীহা, বমি বমি ভাব, পেটব্যথা প্রভৃতি সমস্যা দেখা দিতে পারে। জন্ডিসের তেমন কোনো চিকিৎসা নেই। কেবল বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবার আর সেবাযত্ন। জন্ডিস হলে উল্টাপাল্টা ওষুধ, ভেষজ, টোটকা খেলে আরও ক্ষতি হতে পারে। জন্ডিস এমনিতেই সেরে যায় কিন্তু অনেক সময় জটিল আকার ধারণ করলে পেটে পানি আসার মতো জটিলতা, এমনকি রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
চাই সতর্কতা
- একটু সচেতন হলেই আমরা বর্ষাকালে এই রোগগুলো থেকে মুক্ত থাকতে পারব। খাবার পানি অবশ্যই বিশুদ্ধ ও জীবাণুমুক্ত হতে হবে। সবচেয়ে সহজ উপায় হলো, পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে একটি পরিষ্কার পাত্রে সংরক্ষণ করে পান করা। এ ছাড়া ফিটকিরি ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করা যেতে পারে। ভালো মানের মিনারেল ওয়াটার পান বিকল্প হতে পারে।
- কখনোই পানের জন্য পুকুরের বা নদীর পানি, ট্যাপের পানি সরাসরি ব্যবহার করা যাবে না। আর্সেনিকমুক্ত টিউবওয়েলের পানি পান করা যাবে।
- শুধু পানের ক্ষেত্রে নয়, খাবার তৈরি, পরিবেশন ও গ্রহণ—সব পর্যায়েই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, যেন কোনো জীবাণু শরীরে প্রবেশ করতে না পারে। রান্নার তৈজস ভালো করে ধুয়ে নিন। কাঁচা শাকসবজি ও ফলমূল কখনোই না ধুয়ে খাবেন না। কোনোভাবেই বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। খাবার ভালোভাবে গরম করে খেতে হবে।
- বাইরের বিশেষ করে খোলা খাবার কোনোভাবেই খাওয়া যাবে না। গরমে বাইরে বিক্রি হওয়া পানি, শরবত, জুস প্রভৃতি পান করবেন না।
- ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার কোনো বিকল্প নেই। খাবার গ্রহণের আগে ও টয়লেট ব্যবহারের পরে অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। আর অসুস্থ হলে অবশ্যই নিকটবর্তী রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের কাছে বা নিকটবর্তী হাসপাতালে যেতে হবে, কখনোই নিজে নিজে চিকিৎসা করার চেষ্টা করবেন না।