উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে আপনার করণীয়



উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে আপনার করণীয় কী সে সর্ম্পকে প্রথমআলো পত্রিকায় লিখেছেন জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ।
হৃদ্রোগ ও স্ট্রোক বিশ্বজুড়ে এখন ১ নম্বর ঘাতক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত। বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ৭৯ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে হৃদ্রোগের কারণে, যা মোট মৃত্যুর ৩১ শতাংশ। এসব রোগে যাঁরা মারা যান, তাঁদের অর্ধেকেরই বয়স ১৫-৬৯ বছরের মধ্যে। এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক। কারণ, যে বয়সে জীবন সুন্দর ও কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠে, একজন মানুষ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম, সেই বয়সেই হয় মৃত্যু তাঁকে কেড়ে নেয় বা রোগব্যাধি তাঁকে অথর্ব করে দেয়। অথচ চাইলে আমরা এসব রোগকে প্রতিহত করতে পারি।
হৃদ্রোগের অন্যতম কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ। সাধারণত কারও রক্তচাপ ১৪০/৯০ মার্কারি বা এর বেশি হলে তাকে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্বে ১৫০ কোটির বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশেও প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ২১ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। নানা কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, ধূমপান, কায়িক পরিশ্রম না করা, দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ, মদ্যপান, স্থূলতা, এমনকি বংশগত কারণের প্রভাব আছে।
রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি সবারই মেনে চলা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে নিজের রক্তচাপও জেনে রাখা উচিত। যাঁরা এরই মধ্যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের এটি নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে এবং নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করতে হবে। এটি খুব সহজ এবং ঘরে বসেই করা যায়। এ জন্য নিয়মগুলো জানা প্রয়োজন।
বাড়িতে রক্তচাপ মাপার নিয়ম
চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রক্তচাপ মাপার উপযুক্ত যন্ত্র কিনতে হবে। বাজারে বিভিন্ন মাপের বাহুবন্ধনী পাওয়া যায়, তাই কেনার আগে সঠিকভাবে এর মাপ নির্বাচন করতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী বা বিক্রেতার সহযোগিতা নিতে হবে। মাপ সঠিক না হলে রক্তচাপের পরিমাণ বা রিডিং সঠিক হয় না। বর্তমানে অবশ্য রক্তচাপ মাপার জন্য অনেক ব্র্যান্ডের ডিজিটাল যন্ত্রও পাওয়া যায়।
- রক্তচাপ পরিমাপের আগে অন্তত ৩০ মিনিটের মধ্যে ভারী কোনো কাজ করা, ব্যায়াম করা, হাঁটা ও চা-কফি পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- চেয়ারে হেলান দিয়ে এমনভাবে বসতে হবে যেন পায়ের পাতা মেঝেতে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে, পায়ের ওপর পা উঠিয়ে বসা যাবে না।
- হাতের নিচে তোয়ালে বা বালিশ রেখে এমনভাবে বসতে হবে যেন হাত হৃদ্পিণ্ডের সমান্তরালে থাকে। এক হাতের ওপর অন্য হাত রাখা যাবে না।
- বাহুবন্ধনী সঠিকভাবে হাতে লাগাতে হবে, রক্তচাপের সঠিক রিডিং পেতে এটি গুরুত্বপূর্ণ।
- ১ মিনিটের ব্যবধানে ২-৩ বার রিডিং নিতে হবে। সঠিক নিয়মে রক্তচাপ পরিমাপ করে সঙ্গে সঙ্গেই তা লিপিবদ্ধ করতে হবে।
- সাত দিনব্যাপী বাড়িতে সকাল ও সন্ধ্যা দুবার রক্তচাপ পরিমাপের মাত্রাকে রক্তচাপের রেকর্ড হিসেবে গণ্য করতে হয়।
রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে যা করবেন
সব ধরনের তামাকজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করা থেকে পরিবারের সবাইকে বিরত থাকতে হবে। তামাক গ্রহণের অভ্যাস কারও মধ্যে থাকলে তা আজই ছেড়ে দেওয়ার জন্য মনস্থির করুন।
অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী ব্যক্তিদের নিজ নিজ আদর্শ ওজন ফিরে পেতে চেষ্টা করতে হবে। ব্যক্তির ওজন পরিমাপের দুটি উপায় আছে। বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) এবং পেটের মাপ। বিএমআই একজন ব্যক্তির গড় ওজন নির্দেশ করে। ব্যক্তির ওজন (কিলোগ্রাম) ও উচ্চতার (মিটার) ভাগফলই তার বিএমআই। বিএমআই ১৮.৫-২৪.৯৯-কে আদর্শ ধরা হয়। উল্লেখ্য, দেশ ও জাতিভেদে এ পরিমাপের তারতম্য হতে পারে।
- স্বাস্থ্যসম্মত সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। সকাল, দুপুর ও রাত—এই তিন বেলায় বয়স ও প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণে সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। কোনো বেলার খাবার বাদ দেওয়া যাবে না।
- ফাস্ট ফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- প্রচুর পরিমাণে টাটকা ও রঙিন শাকসবজি, দেশীয় ও মৌসুমি ফলমূল খেতে হবে।
- খাদ্যতালিকায় রেড মিটের পরিবর্তে মুরগির মাংস ও ছোট–বড় বিভিন্ন রকম মাছ রাখতে হবে।
- সপ্তাহে অন্তত এক দিন নিরামিষভোজী হওয়া দরকার।
- রান্না করার সময় অল্প বা পরিমিত লবণ ব্যবহার করতে হবে।
- যতদূর সম্ভব সোডিয়াম ও অন্যান্য লবণ কম পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে। খাবারের সঙ্গে বা পাতে আলগা লবণ গ্রহণ পরিহার করতে হবে।
- খাদ্য সংরক্ষণে লবণের পরিবর্তে ভিনেগার, লেবুর রস, কাঁচা রসুন ও মসলা ব্যবহার করতে হবে।
- খাবার কেনার সময় পণ্যের গায়ে সোডিয়ামের পরিমাণ ভালোভাবে পড়ে অপেক্ষাকৃত কম সোডিয়ামসমৃদ্ধ খাবার বেছে নিতে হবে।
- মদ্যপান বা অ্যালকোহল গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- কায়িক পরিশ্রম করতে হবে, নিজের কাজ নিজে করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
- নিয়মিত হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটার জন্য চেষ্টা করতে হবে। দিনে অন্তত ১০ মিনিট সাধারণ ব্যায়াম করা উচিত।
- লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করতে হবে।
- সম্ভব হলে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে অফিস এবং নিকটবর্তী গন্তব্যে যাওয়ার অভ্যাস করা উচিত।
উচ্চ রক্তচাপ কমাতে ওষুধের ভূমিকা
উচ্চ রক্তচাপে ইতিমধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করতে হবে। কিছু ওষুধ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক প্রতিরোধ করে।
মনে রাখতে হবে...
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে।
- ওষুধ সেবনে অনিয়ম–অবহেলা করলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কোনো ফল পাওয়া যাবে না।
- সাধারণত প্রতিটি ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে, তাই ওষুধ সেবনের ফলে কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসককে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। নিজে নিজে বন্ধ করা বা পরিবর্তন করা চলবে না।
- ওষুধ সেবনের পাশাপাশি নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করতে হবে।