গরমে সুস্থ থাকার উপায়
গরমে সুস্থ থাকার উপায়- লেখাটি প্রথম আলো পত্রিকা থেকে নেয়া হয়েছে, লিখেছেন ডা. মো. মতলেবুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
গ্রীষ্মকালের কেবল শুরু। এর মধ্যেই গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। বিগত বছরগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা অঙ্কের দিক থেকে এরই মধ্যে ছাড়িয়েছে। তার মধ্যেই এসেছে পবিত্র রমজান মাস। করোনার তাণ্ডব তো আছেই। সব মিলিয়ে সময়টা ভীষণ নাজুক।
প্রচণ্ড গরম ও রোদের কারণে এ সময় যেমন কিছু সমস্যা হতে দেখা যায়, তেমনি খাদ্য ও পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যায়। এ সময়ে সুস্থ থাকতে তাই এই দুটি দিকই মাথায় রাখতে হবে।
বর্তমান অতিমারি পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত পৃথিবীতে সুস্থ থাকাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নিজের ও পরিবারের সুস্থতার জন্য সাবধান থাকাটাই কর্তব্য। নিজের অসাবধানতাবশত পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বিপদে আর কষ্টে পড়েন পরিবারের সবাই। অন্যান্য রোগবালাই প্রতিরোধের পাশাপাশি করোনাভাইরাস প্রতিরোধের নিয়মগুলোও মেনে চলুন অবশ্যই। গরমে ভাইরাস মরে যাবে কিংবা গরমে মাস্ক পরে থাকা কষ্ট—এ ধরনের অজুহাতের কোনো সুযোগ নেই।
অতি তাপে অসুস্থতা
পরিবেশের অতিরিক্ত তাপমাত্রায় হতে পারে পানিশূন্যতা, হিট এগজশান, এমনকি হিট স্ট্রোকও। খুব গরমে অবসাদ, মাথাব্যথা, বমিভাব, দুর্বলতা, পেশিতে ব্যথা হতে পারে, প্রচণ্ড তৃষ্ণা অনুভব করতে পারেন, প্রচণ্ড ঘাম হতে পারে। হিট স্ট্রোকের পর্যায়ে চলে গেলে রোগীর জ্ঞানের মাত্রার তারতম্য হতে পারে, রোগী পুরোপুরি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন। এ রকম কোনো লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষাকৃত শীতল স্থানে নিতে হবে। রোগী যদি অচেতন না হন, তাহলে মুখে একটু একটু করে পানি, তরল খাওয়ার ও স্যালাইন কিংবা লবণ মেশানো পানীয় দিতে হবে। তবে জ্ঞানের মাত্রায় তারতম্য থাকলে নিকটস্থ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে চলুন দ্রুত। রোগীর আশপাশে ভিড় করা যাবে না। ভিড় জমালে আবহাওয়া আরও বেশি উষ্ণ হয়ে উঠবে।
এই মহামারি পরিস্থিতিতে এমন প্রচণ্ড গরমে সবচেয়ে ভালো হলো প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না যাওয়া। অকারণে বাজার, বিপণিবিতানে কেনাকাটা এড়িয়ে চলুন। দরকারি কাজে বাইরে গেলেও রোদ এড়িয়ে চলা উচিত। পাতলা ও হালকা রঙের সুতি কাপড় পরুন। রোদে গেলে ছাতা ও রোদচশমা (সানগ্লাস) ব্যবহার করুন। প্রচুর পানি ও তরল পান করতে হবে। লবণশূন্যতা এড়াতে ইফতারের সময় লবণ মেশানো পানীয় বা ফলের রস গ্রহণ করতে পারেন। প্রয়োজনে স্যালাইনও খাওয়া যেতে পারে। তবে কিডনি বা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির পানি, লবণ, ফলের রস প্রভৃতি গ্রহণের মাত্রা চিকিৎসক কর্তৃক নির্ধারণ করা থাকতে পারে।
চাই নিরাপদ পানি, নিরাপদ খাবার
পানিই তো জীবন। বিশেষ করে গরমকালে পানি ছাড়া এক ঘণ্টাও চলে না। কিন্তু খাওয়ার পানি নিরাপদ না হলে তা থেকেই হতে পারে বিপদ। অস্বাস্থ্যকর পানি ও খাবারের মাধ্যমে নানান রোগ হতে পারে। বদহজম এর মধ্যে অন্যতম। অস্বাস্থ্যকর খাবার বা পানীয় গ্রহণের পর পেটব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা—যেকোনোটাই হতে পারে। জ্বর জ্বরও থাকতে পারে। এই মুহূর্তে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ডায়রিয়ার প্রকোপ ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। দূষিত পানি এর কারণ।
প্রতিবার বমি বা পাতলা পায়খানার পর স্যালাইন খেতে হবে। যদি রোগীর উন্নতি না হয়, অবশ্যই কাছের হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। শরীরের পানির ঘাটতি যথাসময়ে পূরণ করা না গেলে পানিশূন্যতার কারণে কিডনি বৈকল্য পর্যন্ত হতে পারে। শিশু ও বয়স্করা ডায়রিয়া হলে ভোগেন বেশি।
গরমকালে কেবল ডায়রিয়া নয়, পানিবাহিত অন্য রোগ, যেমন টাইফয়েড, জন্ডিস বা হেপাটাইটিসের মতো মারাত্মক রোগও ছড়াতে পারে খাবার ও পানির মাধ্যমে। এ ধরনের রোগ এড়াতে অবশ্যই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বাইরের খোলা খাবার খাওয়া যাবে না। খোলা ইফতারি এড়িয়ে চলুন। পথের ধারের মুখরোচক খাবার, শরবত, আখের রস, জুস, আইসক্রিম—কোনোটাই গ্রহণ করা যাবে না।
অনিরাপদ বা অপরিশোধিত পানি দিয়ে তৈরি তরল খাবারে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি। বাড়িতেও পানি ফুটিয়ে পান করুন, বাইরে পানি পান করতে হলে তা একটু কষ্ট করে বাড়ি থেকে বয়ে নিয়ে আসাই ভালো। খাবার ঢেকে রাখুন। নষ্ট হতে পারে, এমন খাবার ফ্রিজের বাইরে সংরক্ষণ করা যাবে না। কাঁচা মাছ-মাংস, রান্না করা খাবার প্রভৃতি সংরক্ষণ করতে হলে যত দ্রুত সম্ভব (খাবারের গরম ভাবটা কেটে গেলেই, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই) ফ্রিজে উঠিয়ে রাখুন। সংরক্ষণ করার প্রয়োজন না থাকলে কাঁচা মাছ-মাংস রান্না করে ফেলুন দ্রুতই, আর রান্না খাবারও খেয়ে নিন খাবারটা ভালো থাকতে থাকতেই। এ ছাড়া খাদ্যসামগ্রী কাটাকুটি, রান্না, পরিবেশন এবং খাওয়ার আগে নিয়মমাফিক হাত ধোবেন অবশ্যই।
গরমে ত্বকের সুস্থতা
গরমে অনেকেরই প্রচণ্ড ঘাম হয়। হয়ে থাকে ঘামাচিও। ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে পানির পাশাপাশি লবণও বেরিয়ে যায়। তাই বেশি ঘামলে সঙ্গে সঙ্গে পানি ও লবণের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। ঘামাচি ও অতিরিক্ত ঘামের সমস্যা প্রতিরোধে গরম আবহাওয়া এড়িয়ে চলার চেষ্টা করাই ভালো। ঘামাচি হওয়ার প্রবণতা থাকলে মাঝেমধ্যে ঠান্ডা পানি দিয়ে শরীর স্পঞ্জ করে নিতে পারেন। তবে খুব বেশি ঘামার প্রবণতা থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত, কেননা অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে কোনো রোগের লক্ষণ। কিছু কিছু চর্মরোগে রোদ এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া যেকোনো ব্যক্তির রোদে যেতে হলে নিয়মমাফিক সানস্ক্রিন সামগ্রী ব্যবহার করতে হবে। শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি হওয়ার জন্য রোদে যাওয়া ভালো, এ কথা আমরা জানি। কিন্তু প্রচণ্ড গরমের সময়টাতে সকাল ১০টার পর রোদে না যাওয়াই ভালো।
আরও যা মানবেন
খুব গরমেও কারও কারও ঠান্ডা লেগে যায়। সর্দি দেখা দেয়। সাইনোসাইটিস হতে পারে। তাপমাত্রার হঠাৎ তারতম্যে এ রকম হয়ে থাকে। তাই খুব ঠান্ডা থেকে বেরিয়ে খুব গরমে আসা কিংবা এর উল্টোটা—কোনোটাই ঠিক নয়। কর্মক্ষেত্রে হয়তো সাময়িক স্বস্তির জন্য তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত কমিয়ে রাখা হয়, সেখান থেকে বেরিয়েই হয়তো রাস্তায় প্রকট গরমে গেলে সমস্যা হতে পারে। তেমনি অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি, বরফ, আইসক্রিম ইত্যাদির কারণেও অসুস্থ হতে পারেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার করলে ঘরের তাপমাত্রা একটা সহজ ও সহনীয় সীমার মধ্যেই রাখা ভালো।