কিভাবে করোনাকালীন সময়ে সতর্ক ও সচেতন থাকবেন
কিভাবে করোনাকালীন সময়ে সতর্ক ও সচেতন থাকবেন সে সম্পর্কে প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং কোভিড–১৯ বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা।
করোনাকালেই বছর ঘুরে আবার এসেছে পবিত্র রমজান মাস। গত বছর রমজানের আগে বাংলাদেশে কোভিড–১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর দেশজুড়ে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এ বছরও একই সময়ে কোভিড রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু আকস্মিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী। এ কারণে রমজানের আগে সরকার দেশজুড়ে সাময়িক লকডাউন ঘোষণা করেছে। এই মুহূর্তে মানুষের ব্যাপক চলাচল রোধ করতে পারলে সংক্রমণ কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এরই মধ্যে সংক্রমণ বিপজ্জনক হারে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণের রকমফের বুঝে হয়তো লকডাউনের মেয়াদ আরও বাড়বে।
অথচ এরই মধ্যে নিতে হচ্ছে রোজার প্রস্তুতি। রমজান উপলক্ষে আমাদের নিত্য জীবনযাত্রায় খাদ্যাভ্যাসে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। রমজানের পরপরই আসে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ, তারও কিছু প্রস্তুতি থাকে। এই সময় কাঁচাবাজার, রেস্তোরাঁ, বিপণিবিতানে বাড়ে ভিড়। গ্রাম ও শহরের মধ্যে মানুষের ভ্রমণ ও চলাচল বাড়ে। কিন্তু এ বছর নিতে হবে কঠোর সতর্কতা, নয়তো উৎসব বিষাদে পর্যবসিত হতে পারে।সর্বোচ্চ সতর্ক থাকুন
রমজান মাসে নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে রোজা পালন ও তারপর উৎসব উদ্যাপন হয়ে উঠবে অনিশ্চিত। সে জন্য এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করুন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। যেতে হলে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করবেন। ভিড় ও জনসমাগম এড়িয়ে চলবেন। দূরত্ব বজায় রাখবেন।
মনে রাখবেন, নিজের শরীরের যত্ন নেওয়া বড় ইবাদত। তাই এ বছর ঘরে বসেই যথাসম্ভব ইবাদত করুন। যাঁরা বয়স্ক, আর যাঁদের নানা রকম রোগবালাই যেমন ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি সমস্যা আছে, তাঁদের মসজিদে না গিয়ে বাড়িতেই তারাবিহ নামাজ আদায় করা ভালো। কেউ যদি মসজিদে যান, তবে সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। মাস্ক পরবেন, মসজিদে প্রবেশ ও বের হওয়ার পর হাত ধোবেন বা স্যানিটাইজ করবেন, নিজস্ব জায়নামাজ সঙ্গে নেবেন। যেকোনো কারণে বাইরে গেলে বাড়ি ফিরে অবশ্যই ভালো করে হাত ধোবেন এবং পোশাক পরিবর্তন করে নেবেন।
বাড়ির বাইরে ইফতার বা সাহ্রি পার্টিতে অংশ নেবেন না, বাড়িতেও কাউকে আমন্ত্রণ করবেন না। ভিড় জমিয়ে দান খয়রাত, খাবার বা জাকাত বণ্টন করবেন না। বাড়িতে তৈরি সহজপাচ্য পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। পানিশূন্যতা যেন না হয়, সে জন্য
পর্যাপ্ত পানি পান করবেন। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে খাবেন ফলমূল, শাকসবজি।
এক বছর ঈদের জামাকাপড় উপহার ও কেনা নিয়ে মাতামাতি না করলে কিছুই আসে যায় না। রোজা সংযমের মাস, আর এখন সংযমের পরীক্ষা দেওয়ার বছর। খাবারদাবার থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক, উৎসব উদ্যাপন—সর্বত্র সংযম পালন করুন। আপনার ত্যাগ হয়তো আরও শত জীবন বাঁচিয়ে দেবে; বরং লকডাউনে যারা আয়–রোজগার নিয়ে বিপদে পড়বে, অর্থ সাহায্য নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান। উৎসব না হয় না–ই উদ্যাপন করলেন। আপনার অবিমৃশ্যকারিতার জন্য নিজের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবন বিপন্ন হতে পারে।
দূরপাল্লার ভ্রমণ বাদ দিতে পারলে ভালো। যদি বাড়ি যেতেই হয়, তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্কতার সঙ্গে ভ্রমণ করুন।
অসুস্থ হলে অবহেলা নয়
কোভিড–১৯ প্রতি মুহূর্তে তার চরিত্র বদলাচ্ছে। স্বাদ-গন্ধ না পাওয়া বা জ্বরের মতো উপসর্গ এখন অনেকেরই হচ্ছে না। কারও শুধু মাথাব্যথা, শরীরব্যথা, দুর্বলতা, অবসাদের মতো উপসর্গ আছে। যেকোনো সন্দেহজনক উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই পরীক্ষা করান।
এরই মধ্যে মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় নেতারা জানিয়েছেন, রোজা রেখে নাক থেকে পিসিআর পরীক্ষার জন্য সোয়াব দিতে কোনো বাধা নেই। তাই পরিবারে বা আশপাশে কারও শারীরিক সমস্যা বুঝতে পেলে দ্রুত পরীক্ষা করান। সেই সঙ্গে আইসোলেশন বজায় রাখুন। আপনি রোজা রাখতে পারবেন কি না চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। করোনা হলে প্রচুর পানি, তরল, ফলমূল, আমিষ খেতে হয়, তাই রোজা ভাঙতে হতে পারে। যাঁদের ডায়াবেটিস ও অন্যান্য রোগ আছে, তাঁরা বেশি সতর্ক থাকবেন।
চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে বা অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে হাসপাতালে ভর্তি দরকার হতে পারে। রমজান মাস বলে তাতে দেরি করা যাবে না। কারণ, সামান্য দেরিতে ফুসফুসসহ অন্যান্য অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
টিকা নিন
মার্চের শুরুতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইংরেজি পত্রিকা গালফ নিউজ–এ প্রকাশিত ঘোষণায় দুবাইয়ের গ্র্যান্ড মুফতি এবং ইসলামিক অ্যাফেয়ারের ফতোয়া বিভাগের প্রধান শেখ আহমেদ বিন আবদুল আজিজ আল হাদ্দাদ জানান, রমজান মাসে মাংসপেশিতে কোভিডের টিকা নিলে রোজা ভাঙবে না। একই সময় ব্রিটিশ ইসলামিক মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনও এক বার্তায় যুক্তরাজ্যের মুসলিমদের জানায়, রোজা রেখে করোনার টিকা নেওয়া যাবে, এতে সমস্যা নেই। যাঁদের রমজান মাসে টিকার তারিখ পড়বে, তাঁদের রোজা রেখেই তা নিয়ে নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। মার্চের মাঝামাঝি বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সরকার ইতিমধ্যে টিকার দ্বিতীয় ডোজের তারিখ ঘোষণা করেছে। যাঁরা প্রথম ডোজ নিয়েছেন, রমজানে তাঁদের দ্বিতীয় ডোজের তারিখ পড়লে অবশ্যই টিকা নিতে ভুলবেন না। তবে টিকা নেওয়ার পরও মাস্ক পরা, দূরত্ব বজায় রাখাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কারণ, টিকা নেওয়ার পর যথেষ্ট কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগতে পারে। তা ছাড়া বিশাল জনগোষ্ঠী টিকা না নিলে টিকার সুফল পাওয়া যাবে না।