শিরায় রক্ত জমাট বাঁধলে কী করবেন?
শিরায় রক্ত জমাট বাঁধলে কী করবেন সে সর্ম্পেকে প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন ডা. শরদিন্দু শেখর রায়, হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ।
নানা কারণে অকস্মাৎ শিরায় রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। একে বলে থ্রম্বোএম্বোলিজম। তবে পায়ের বড় শিরায় রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস বা ‘ডিভিটি’ নামে পরিচিত। ডিভিটির পূর্ণরূপ হলো ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস বা শিরায় রক্ত জমাট বাঁধা। আমাদের সারা শরীরে শিরা ও ধমনি (রক্তনালি) জালের মতো বিস্তৃত। শিরাগুলো হৃদ্যন্ত্রে রক্ত বয়ে আনে, আর ধমনিগুলো হৃদ্যন্ত্র থেকে পুরো শরীরে রক্ত সরবরাহ করে। কিছু শিরা চামড়ার নিচে থাকে, আবার কিছু শিরা মাংসপেশির ভেতর দিয়ে গভীরে প্রবাহিত হয়।
ঝুঁকি বেশি যাঁদের
যেকোনো বয়সে ডিভিটি হতে পারে। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে ঝুঁকিও বাড়ে। ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। উচ্চতা অনুযায়ী যাঁদের ওজন বেশি, আগে কখনো ডিভিটি হয়েছিল অথবা রক্তের সম্পর্কের কারও ডিভিটির ইতিহাস আছে, তাঁদের ঝুঁকি বেশি। যেসব নারী দীর্ঘদিন জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ ব্যবহার করেন কিংবা মেনোপজের পর হরমোন নিচ্ছেন, তাঁরা ডিভিটির ঝুঁকিতে থাকেন। গর্ভকালীন এবং প্রসব–পরবর্তী ছয় সপ্তাহ সময়ও ঝুঁকিপূর্ণ। দীর্ঘ ভ্রমণ, যদি একনাগাড়ে অনেকক্ষণ (চার ঘণ্টার বেশি) বসে থাকতে হয়, এমন অবস্থাও পারে ডিভিটির ঝুঁকি বাড়াতে। যেসব অস্ত্রোপচারে আধা ঘণ্টার বেশি সময় লাগে, বিশেষ করে পায়ে এবং পেটের কোনো অস্ত্রোপচারে, যদি দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকতে হয়, যেমন হাড় ভাঙা, ক্যানসার, স্ট্রোক, হার্ট ফেইলিউর কিংবা নিউমোনিয়া রোগীর ডিভিটি হতে পারে।
বুঝবেন কী করে
কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সম্পূর্ণ পায়ে ব্যথা, পা ফোলা, পায়ের ত্বক বিবর্ণ হওয়া এবং অন্য পায়ের তুলনায় আক্রান্ত পা উষ্ণ হওয়া ডিভিটির প্রাথমিক উপসর্গ। ঝুঁকিপূর্ণ কোনো ব্যক্তির এমন উপসর্গ দেখা দিলে ডিভিটি বা শিরায় রক্ত জমাট বাঁধার সন্দেহ করতে হবে এবং দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
জটিলতা
শিরায় রক্ত জমাট বাঁধার একটি বড় জটিলতা হলো, জমাটবদ্ধ রক্ত ফুসফুসের শিরায় প্রবাহিত হয়ে ফুসফুসের শিরাকে ব্লক করে দিতে পারে। একে পালমোনারি এম্বোলিজম বলে। এটি একটি গুরুতর অবস্থা। ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস, শ্বাসকষ্ট এবং বুকে ব্যথা এই জটিলতার লক্ষণ। এই জটিলতা হলে মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি।
প্রতিরোধে করণীয়
- উচ্চতা অনুযায়ী সঠিক ওজন বজায় রাখতে হবে।
- প্রতিদিন নিয়মিত কমপক্ষে আধা ঘণ্টা হাঁটতে হবে।
- যাঁরা একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় বসে কাজ করেন, তাঁরা কাজের ফাঁকে একটু হাঁটাহাঁটি করবেন অথবা দু-এক ঘণ্টা পরপর পায়ের পেশি সচল থাকে এমন কোনো ব্যায়াম করবেন।
- দীর্ঘ ভ্রমণে পায়ের আঙুল, পায়ের পাতা এবং পা সচল রাখার চেষ্টা করতে হবে। মাঝেমধ্যে আসনে পা তুলে বসা যেতে পারে। বসে বসেই পায়ের ব্যায়াম করবেন।
- দীর্ঘদিন যাঁরা শয্যাশায়ী হয়ে আছেন, তাঁরাও রোজ পায়ের পাতা ও পায়ের ব্যায়াম করবেন।
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধের ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। অনেক ওষুধের ব্যবহার শিরায় রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা তৈরি করে।
করোনায় শিরায় রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা
মাঝারি থেকে তীব্র উপসর্গের করোনা রোগীদের শিরায় রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাঁদের ৪০ শতাংশ শিরায় রক্ত জমাট বাঁধার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। আরেকটি গবেষণার তথ্যমতে, গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগীর শিরায় রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা তৈরি হয় ১৮ থেকে ২৮ শতাংশে। করোনা হলে তীব্রতা বুঝে ও পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে রক্ত জমাট না বাঁধার জন্য ইনজেকশন বা ওষুধ দিতে পারেন চিকিৎসক।
করোনার টিকায় কি রক্ত জমাট বাঁধে
করোনার টিকা দিলে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে—এমন একটি অভিযোগ ওঠায় ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ করোনার টিকা স্থগিত রেখেছিল। কিন্তু তদন্তের পর ইউরোপীয় মেডিসিনস এজেন্সি (ইএমএ) ঘোষণা করেছে, করোনার টিকার সঙ্গে রক্ত জমাট বাঁধার কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি, আর এটি নিরাপদ ও কার্যকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও জানিয়েছে, ১ কোটি ৭৯ লাখের বেশি মানুষ ইউরোপে এই টিকা নিয়েছেন, আর রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা শতাধিকও নয়, উপরন্তু তা সরাসরি টিকার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ফলে ফ্রান্স, ইতালি, স্পেনসহ অন্যান্য দেশ আবার টিকা কার্যক্রম শুরু করছে।