দেশেই ফুসফুসের ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসা
দেশেই ফুসফুসের ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসা এ সম্পর্কে প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামান চৌধুরী।
বাংলাদেশে প্রায় ২১ লাখ রোগী ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত। তাঁদের মধ্যে ১৩ লাখই পুরুষ। ৮০-৯০ শতাংশ ফুসফুসের ক্যানসারের কারণ হলো ধূমপান, তামাক ও জর্দা খাওয়া। এ ছাড়া রেডিয়েশন বা বিকিরণ, পরিবেশদূষণ, জিনগত প্রভাব, পারিবারিক ইতিহাস আক্রান্ত হতে ভূমিকা রাখে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের উৎকর্ষের কারণে সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির পাশাপাশি ক্যানসার চিকিৎসায় যুক্ত হয়েছে আরও আধুনিক ইমিউনোথেরাপি ও মলিকুলার টার্গেটেড থেরাপি। এসব আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতির কারণে ফুসফুসের ক্যানসারে মৃত্যুহার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আশার কথা যে বাংলাদেশেও এ ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি সহজলভ্য হয়ে উঠেছে।
শল্যচিকিৎসায় বিপ্লব
প্রযুক্তিগত সুবিধার কারণে আধুনিক শল্যচিকিৎসায় প্রায় বিপ্লব ঘটে গেছে। এর একটি উদাহরণ হলো ভ্যাটস বা ভিডিও–অ্যাসিস্টেড থোরাকোস্কোপিক সার্জারি। এই পদ্ধতিতে একটি ছোট ক্যামেরা বা থোরাকোস্কোপ আর সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি এক বা একাধিক ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে বুকের পর্দার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করানো হয়। আর ফুসফুসের টিউমারটি সহজে অপসারণ করে ফেলা যায়। ভ্যাটস পদ্ধতিতে পাঁজরের কোনো হাড় অপসারণ করতে হয় না আর বুকের পেশিও খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এর ফলে সার্জারির পর রোগীর ব্যথা অনেক কম হয়, হাসপাতালেও থাকতে হয় কম সময়।
রেডিওথেরাপিতে আধুনিকতা
এসবিআরটি বা স্টেরিওটেকটিক বডি রেডিয়েশন থেরাপি একটি আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি। যাদের ফুসফুসের ক্যানসার প্রান্তের দিকে অবস্থিত, লসিকাগ্রন্থিতে ছড়ায়নি, আর যারা সার্জারির অনুপযুক্ত বা সার্জারি করতে অনিচ্ছুক, তাদের জন্য এটি আদর্শ পদ্ধতি। এতে সুনিপুণ ও নির্ভুলভাবে ক্যানসার সেলের মধ্যে স্বল্প সময়ে উচ্চমাত্রার রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করা যায়। এই পদ্ধতিতে ফুসফুসের চারপাশে অবস্থিত স্বাভাবিক কোষগুলোর বিকিরণজনিত ক্ষয়ক্ষতি বা ঝুঁকি কম। সাধারণ রেডিওথেরাপির তুলনায় এসবিআরটি অনেক বেশি কার্যকর ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন। বর্তমানে বাংলাদেশেও এই পদ্ধতি সহজলভ্য।
টার্গেটেড মলিকুলার থেরাপি
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে অনকোজেনিক ড্রাইভার জিন নামে কিছু জিনের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়, যা টিউমার বা ক্যানসার বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এদের মধ্যে রয়েছে ইজিএফআর, এএলকে, আরওএস ১, এমইটি, আরইটি, এইচইআর ২, কেআরএসএস জিন ইত্যাদি। এসব জিনের মিউটেশন বা কার্যক্ষমতা কমাতে বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নতুন টার্গেটেড মলিকুলার থেরাপি আবিষ্কার করেন এবং সফল হন।
এর ফলে ফুসফুসের ক্যানসার চিকিৎসায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটে। এতে যে সুনির্দিষ্ট মলিকুল বা জিনের অস্বাভাবিকতার কারণে কারও ক্যানসার কোষ দ্রুত অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে, তাকে একটি নির্দিষ্ট বায়োকেমিক্যাল পথের মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয় কিংবা থামিয়ে দেওয়া হয়। এই টার্গেটেড মলিকুলার থেরাপিতে যে ওষুধ ব্যবহৃত হয়, তাকে টাইরোসিন কাইনেজ ইনহিবিটর নামে অভিহিত করা হয়। সাধারণ কেমোথেরাপির সঙ্গে এর পার্থক্য হলো, টার্গেটেড থেরাপি শুধু খারাপ ও ক্যানসারের নেপথ্যে দায়ী মলিকুলগুলোকে টার্গেট ও ধ্বংস করে, আশপাশের স্বাভাবিক কোষগুলোর ক্ষতি করে না। তাই কেমোথেরাপির তুলনায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম হয়, আর এটি সুনিপুণভাবে নির্দিষ্ট ক্যানসার সেলকে আক্রমণ করার জন্যই প্রস্তুত থাকে।
ইমিউনোথেরাপি
ইমিউনোথেরাপি ক্যানসার চিকিৎসায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। এটি শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধকারী উপাদানগুলো এবং ক্যানসার সেলকে আক্রমণের উপযোগী ও সক্রিয় করে তোলে। ২০১৫ সালে প্রথম ক্যানসার রোগীর চিকিৎসায় এর ব্যবহারে সফলতা মেলে। ইমিউনোথেরাপির এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এফডিএ বর্তমানে আরও এ ধরনের ওষুধের ব্যবহারকে অনুমোদন দিয়েছে।
লিকুইড বায়োপসি
ফুসফুসের ক্যানসার চিকিৎসায় এই দশকের সবচেয়ে বড় সাফল্য এটি। এই পদ্ধতিতে ক্যানসার টিস্যু বা রক্তে ভাসমান টিউমারের ডিএনএ মিউটেশন পর্যবেক্ষণ করে নতুন টার্গেটেড ওষুধ ব্যবহার করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যানসার অনেক সময় রেডিওলজি বা ইমেজিংয়ের মাধ্যমে ধরা পড়ে না। সে ক্ষেত্রে লিকুইড বায়োপসি একটি কার্যকর সমাধান। এর মাধ্যমে রক্তে ভাসমান টিউমার ডিএনএকে শনাক্ত করা যায়। সার্জারির পর টিউমার বা ক্যানসার আবার ফিরে এল কি না, ফলোআপে তা জানতে ইমেজিংয়ের চেয়ে এই পদ্ধতি ৭৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই প্রায় পাঁচ মাস আগেই শনাক্ত করতে সক্ষম। ফুসফুসের ক্যানসার আগেভাগে শনাক্ত করা আর এই পদ্ধতি অবলম্বন করে টার্গেটেড থেরাপি প্রয়োগ করার প্রচলন বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে।