নিউমোনিয়ার কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে যা আমাদের জানা দরকার
নিউমোনিয়া হচ্ছে ফুসফুসে জীবাণুর সংক্রমণজনিত একটি রোগ। বয়স্কদের বেশী হলেও শিশু, তরুণ সহ স্বাস্থ্যবান লোকদেরও রোগটি হতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। চলুন রোগটির কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিই।
নিউমোনিয়া শব্দটির সঙ্গে আমরা কমবেশী সবাই পরিচিত। এটি হচ্ছে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া অথবা ছত্রাকের সংক্রমণে ফুসফুসের প্রদাহজনিত জনিত রোগ। এ রোগ সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের অর্থাৎ যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল গেছে তাদের বেশী হয়ে থাকে। তবে এ রোগটি শিশু, তরুণ এমনকি স্বাস্থ্যবান লোকদেরও হতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না করলে এর কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আসুন নিউমোনিয়ার কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিই।
নিউমোনিয়া কি?
নিউমোনিয়া ফুসফুসের প্রদাহ জনিত একটি রোগ যা ব্যাকটেরিয়া,ভাইরাস,ছত্রাক কিংবা অন্য যেকোন পরজীবীর সংক্রমণের কারণে হতে পারে। কারও রোগটি হলে তাঁর শরীরে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইডের স্বাভাবিক আদান প্রদান প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। রোগটি হলে ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দেহে বাতাসের আদান প্রদান প্রক্রিয়া অনেক বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে শরীর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় যার কারণে ক্ষতিকর কার্বন ডাই অক্সাইড শরীরে জমা হয়ে দ্রুত মস্তিস্ক, হৃৎপিন্ড, কিডনি ইত্যাদিকে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে রোগী দ্রুত মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়তে পারে।
নিউমোনিয়া কিভাবে ছড়ায়?
এটি বায়ুবাহিত অত্যন্ত সংক্রামক একটি রোগ যার কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ বছরের কম বয়সী শতকরা ২২ জন শিশু মারা যায়। এ রোগের জীবাণু বিভিন্ন প্রকারে ছড়িয়ে থাকে। যেমন-
· রোগাক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
· নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে কোন সুস্থ ব্যক্তি আসলে কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার করা কোন জিনিস ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁর শরীরে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে।
· এ রোগের জীবাণু সুস্থ মানুষের নাক ও মুখে থাকতে পারে যা শ্বাস গ্রহনের মাধ্যমে ফুসফুসে ছড়িয়ে এ রোগ হতে পারে।
· আবার কিছু ক্ষেত্রে জীবাণু রক্তের সাহায্যেও ফুসফুসে সংক্রমিত হতে পারে।
কাদের নিউমোনিয়া বেশী হয়?
যদিও নিউমোনিয়া যে কারোরই হতে পারে তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি যেমন-
· ছোট্ শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের।
· যারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, হৃদরোগ কিংবা ফুসফুসের কোন রোগ ভুগছে এমন ব্যাক্তি।
· কারও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে যেমন এইডস হলে।
· যারা ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি নিচ্ছেন।
· যারা স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবন করছেন।
· যারা ধূমপান কিংবা মাদকে আসক্ত।
নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণসমূহ
নির্দিষ্ট সময়ের আগে শিশুর জন্ম হওয়া, ওজন কম হওয়া, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, টিকা সময়মত না নেওয়া অথবা অন্য কোন শারীরিক অসুস্থতার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে পরবর্তী জীবনে সহজেই সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। নিউমোনিয়া রোগের কতিপয় লক্ষণ নিম্নরুপ-
· জ্বর, কাশি অথবা শ্বাসকষ্ট হওয়া।
· বয়স অনুযায়ী শ্বাস দ্রুত মনে হওয়া।
· অস্থিরতা ভাব হওয়া।
· খাবারে অরুচি হওয়া
· বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া।
· পেটে ব্যথা হওয়া।
· শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া।
· মারাত্মক নিউমোনিয়ার হলে শ্বাস নেয়ার সময় বুকের নিচের অংশ ভিতরে ঢুকে যাওয়া।
· শ্বাসকষ্টের কারণে রোগীর খিঁচুনি হতে পারে।
· নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় নাক ফুলে উঠতে পারে। মুখ ও ঠোঁটের চারপাশ নীল হয়ে যেতে পারে, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে এমনকি রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
নিউমোনিয়ার চিকিৎসা
লক্ষণ বা উপসর্গ দেখে নিউমোনিয়া হয়েছে মনে হলে অতি দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনে শারীরিক পরীক্ষা, বুকের এক্সরে ও প্রয়োজনীয় রক্ত, কফ বা শ্লেষ্মা পরীক্ষা ইত্যাদি করাতে হতে পারে। রোগীর পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে চিকিৎসক চিকিৎসার ব্যপারে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এ সময় রোগীর খাদ্য এবং পানীয় সম্পর্কেও অধিক যত্নবান হতে হবে। নিউমোনিয়াজনিত শিশু মৃত্যুর হার যেহেতু অত্যন্ত বেশি তাই শিশুদের বেলায় অধিক যত্নবান হতে হবে । আর যেকোনো প্রয়োজনে অবশ্যই দ্রুততার সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করতে হবে।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে করণীয়
নিউমোনিয়া চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধে সতর্ক হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সবাইকে নিউমোনিয়া প্রতিরোধে নিম্নলিখিত বিষয়গুলিতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে-
· অবশ্যই বাড়ির সবাইকে দিনে সাবান দিয়ে কয়েকবার ভালভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে।
· অপরিণত বা স্বল্প ওজনের শিশুরা পরবর্তীতে খুব সহজেই নানান রোগে আক্রান্ত হয় তাই গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে যাতে অপরিণত বা স্বল্প ওজনের শিশুর জন্ম না হয়।
· আর যদি কোন শিশু অপরিণত বয়সে জন্ম নেয় তাহলে তাদের ব্যপারে অতিরিক্ত সতর্কতা থাকা জরুরি।
· যেহেতু শিশুরা নিউমনিয়ায় বেশী ভোগে তাই শিশু যাতে অপুষ্টির শিকার না হয় এজন্য তার জন্মের প্রথম ৬ মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। বাচ্চার বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলে তাকে মায়ের দুধের পাশাপাশি বাড়িতে তৈরি পুষ্টিকর খাবারও খাওয়াতে হবে।
· অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম থাকে। তাই শিশুর বয়স ২ বছর পুর্ণ হওয়া পর্যন্ত অবশ্যই অন্যান্য খাবারের সঙ্গে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোও চালিয়ে যেতে হবে।
· সময়মত শিশুকে সবগুলো টিকা দিতে নিতে হবে।
· কারও ঠাণ্ডা বা কাশি হলে অথবা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগী থেকে দূরে রাখতে হবে।
· শিশুর থাকার জায়গা এবং বাড়ির পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
· বাড়িতে আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
· শিশুকে সিগারেট বা চুলার ধোঁয়া থেকে দূরে রাখতে হবে।
· বয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, ধূমপান ত্যাগ করতে হবে।
· আর অন্যের সামনে হাঁচি বা কাশি দেয়ার সময় হাত বা রুমাল দিয়ে অবশ্যই মুখ ঢেকে নিতে হবে।
নিউমোনিয়া হলো ফুসফুসের এক প্রকার ইনফেকশন ও অত্যন্ত সংক্রামক একটি রোগ। এ রোগের জীবাণু রোগাক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে সহজেই বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ও অন্যদের আক্রমণ করে। এটি অত্যন্ত সংক্রামক রোগ বিধায় এর প্রতিরোধে সবার সবসময় সচেতন থাকতে হবে। শিশুসহ পরিবারের সকলের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া, দিনে কয়েকবার সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধোয়া, ধূমপান বর্জন সহ নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু বা ব্যক্তি থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে সহজেই রোগটির সংক্রমন থেকে নিরাপদে থাকা সম্ভব।