ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারঃ নবজাতক মৃত্যুর হার কমানোর সহজ ও সহজলভ্য উপায়
প্রি-ম্যাচিউর শিশুদের চিকিৎসার জন্য ১৯৭৮ সালে কলম্বিয়ায় সর্বপ্রথম ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি চালু হয়ে এখন পুরো বিশ্বে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। এটি ইনকিউবেটরের চেয়ে অধিক কার্যকর। চলুন পদ্ধতি ও এর বিভিন্ন সুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
প্রি-ম্যাচিউর শিশুদের চিকিৎসার জন্য ইনকিউবেটরের বিকল্প হিসেবে ১৯৭৮ সালে কলম্বিয়ার চিকিৎসক ‘নাথালি চারপাক’ ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার বা কেএমসি পদ্ধতি প্রথম প্রচলন করেন যা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, সুইডেন, ভারতসহ পুরো বিশ্বে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি অধিক কার্যকর, যাতে শিশু ইনকিউবেটরের চেয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। কোনো খরচ ব্যতিরেকেই এই পদ্ধতিতে নবজাতক শিশুর মৃত্যুহার অনেক কমানো সম্ভব। চলুন ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি ও এর সুবিধা সমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার বা কেএমসি পদ্ধতি কী?
ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার বা কেএমসি হচ্ছে অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহন করা একটি শিশুর জীবন রক্ষায় প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া একটি সফল চিকিৎসা সেবা। প্রাণীদের মধ্যে ক্যাঙ্গারু যেভাবে তাঁর জন্ম নেয়া অপরিণত বাচ্চাকে তার বুকের থলের ভেতরে আগলে রেখে মাতৃদেহের উমে বড় করে তুলে সেই কৌশলকে অনুসরন করে এই পদ্ধতিটি চালু হয়। ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ পদ্ধতিতে স্বাভাবিক সময়ের পূর্বে জম্ম নেয়া কম ওজনের নবজাতক শিশুকে মায়ের বা পরিবারের অন্য যেকোন সদস্যদের বুকের মধ্যে রেখে মায়ের ও নবজাতকের ত্বকে-ত্বকে একটি নিবিড় আলিঙ্গনের মাধ্যমে উষ্ণতার আবহ প্রস্তুত হয়। এ পদ্ধতিতে প্রয়োজন অনুসারে মা তাঁর শিশুকে সময়মতো বুকের দুধ খেতে দিতে পারেন। আর এভাবেই মায়ের বুকের উত্তাপ এবং দরকার মতো শিশুকে খাওয়ানোর ফলে শিশুটি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। তাছাড়া এই পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান ও মায়ের মধ্যে একটি দৃঢ় বন্ধনও তৈরি হয়। হাসপাতালের পরিবর্তে বাড়ির পরিবেশে এই পদ্ধতিতে থাকলে নবজাতক ও মা উভয়ই বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে ব্যাবস্থাপনা যেন অবশ্যই যেন মা ও শিশুর জন্য আরামদায়ক হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ জন্য বিশেষ বেড বা চেয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে। ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার শিশুর ওজন ২৫০০ গ্রাম না হওয়া পর্যন্ত চালু রাখতে হবে। যখন শিশুটি পরিণত হবে তখন সে নিজে থেকেই হাত-পা বেশি নড়াচড়া সহ অঙ্গগুলো টেনে বের করতে চাইবে, কাঁদবে এবং মায়ের শরীরে আর লেগে থাকতে চাইবে না। এই অবস্থায় ক্যাঙ্গারু কেয়ার পদ্ধতি বন্ধ করে স্বাভাবিকভাবে বাচ্চাকে রাখতে হবে।
ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতির সুবিধা সমূহ
- অপরিণত ও কম ওজনে জন্ম গ্রহণ করা নবজাতক বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখতে ইনকিউবেটরের বিকল্প হিসাবে জনপ্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে ক্যাঙ্গারু কেয়ার। এ পদ্ধতিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কিংবা নার্সের দরকার হয়না, তাই এতে কোনো খরচও নেই।
- এই পদ্ধতিতে শিশুটিকে মায়ের স্তনের কাছাকাছি রাখা হয় যা মাতৃদুগ্ধ উৎপাদনে সহায়তা করে। তাই জন্মের পরপরই ক্যাঙ্গারু কেয়ার পদ্ধতি চালু করে মায়ের বুকের সঙ্গে বাচ্চাটিকে লাগিয়ে দেওয়া দরকার।
- ক্যাঙ্গারু কেয়ারের মাধ্যমে মায়ের সাথে নবজাতকের একটি আত্মিক সম্পর্ক জন্মে এবং তা ধীরে ধীরে নবজাতকটিকে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানানসই হয়ে উঠতে সহায়তা করে।
- যেহেতু এই পদ্ধতিতে শিশুটি তাঁর মায়ের বুকের সাথে লম্বালম্বি অবস্থায় থাকে তাই নবজাতকটির শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে উন্নতি হয় এবং হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিক গতি ফিরে পায়। যার ফলে শিশুটির মৃত্যুঝুঁকি অনেক কমে যায়।
- এই পদ্ধতিতে থাকা বাচ্চাকে সহজেই মায়ের দুধ খাওয়ানো যায়। প্রয়োজন হলে কাপ, চামচ বা নলও ব্যবহার করেও খাওয়ানো সম্ভব।
- যেহেতু বাচ্চাটি সার্বক্ষণিক মায়ের অত্যন্ত কাছাকাছি থাকে তাই বাচ্চার কোনো প্রকার জটিলতা দেখা দিলে মা খুব দ্রুত বুঝতে পারে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসককে সে বিষয়ে জানাতে পারে।
- মায়ের অনুপস্থিতিতে বিশেষ প্রয়োজন হলে বাচ্চার বাবা, দাদি-নানিরাও এ পদ্ধতিতে সাময়িকভাবে নবজাতককে বুকের সঙ্গে আগলে রাখতে পারেন।
কাদের জন্য ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতিটি প্রযোজ্য?
নবজাতক শিশুর কয়েকটি প্রধান সমস্যা্র মধ্যে প্রি-ম্যাচিউর বা অপরিণত বাচ্চা, ইনফেকশন, জন্মের পর এক মিনিটের মধ্যে না কাঁদা বা শ্বাস না নেওয়া, জন্ডিস এবং জন্মগত ত্রুটি অন্যতম। ৪০ সপ্তাহের মধ্যে যদি শিশু জন্মগ্রহন করে তাহলে সেতাকে আমরা স্বাভাবিক হিসাবে গণ্য করি যা ৩৭ সপ্তাহ হলেও স্বাভাবিক ধরা হয়। যদি কোন শিশুর জন্ম স্বাভাবিকভাবে কিংবা সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে ৩৭ সপ্তাহের আগেই জন্মগ্রহন করে তবে শিশুটিকে প্রি-টার্ম বা অপরিণত শিশু হিসাবে গণ্য করা হয়। অপরিণত বলে এই সময় শিশুটির শরীরের তাপমাত্রা অনেক কম থাকে এবং অনেকসময় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অপরিণত অবস্থায় থাকে। যার ফলে ফলে শিশুটির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে যায়। ফলে নবজাতক শিশুতি মায়ের বুকের দুধ ভালোভাবে টেনে নিতে পারে না। অনেকসময় তাঁর খাবার পাকস্থলীতে না গিয়ে ফুসফুসে চলে যায় এবং এ কারণে তাঁর শ্বাসও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া তাঁর জন্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাসহ তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই এসব নবজাতক শিশুদের ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতি্র মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দেওয়া যেতে পারে। নবজাতক শিশুর মৃত্যুর আরো একটি প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের ওজন স্বল্পতা (আড়াই কেজির কম) নিয়ে জন্ম নেওয়া। এসব অপরিণত নবজাতক শিশুদের শরীর গরম রাখা, ঠিকমতো পুষ্টি দেওয়া,শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধ সহ সর্বোপরি তাদের বাঁচাতে সমন্বিত ও জনপ্রিয় পদ্ধতিই হচ্ছে ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর সোয়া চার লাখ অপরিণত বয়সের নবজাতক জন্মগ্রহণ করে থাকে। এসব অপরিণত বাচ্চা জন্মের জন্য সাধারণত কিশোরী বয়সে বিয়ে বা বাল্যবিয়ে, মায়ের অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, গর্ভাবস্থায় পানি আগে ভাঙা, গর্ভকালীন রক্তপাত, হঠাৎ পড়ে যাওয়া, ধূমপান বা তামাক গ্রহণ করা, মায়ের রক্তশূন্যতা ইত্যাদি বিশেষভাবে দায়ী। তাই অপরিণত ও অপেক্ষাকৃত কম ওজনের নবজাতক শিশুর অকাল মৃত্যুরোধে উপরোক্ত অবস্থাসমূহ প্রতিরোধ সহ ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত।