রোজাদারের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার
শুরু হয়েছে রমজান মাস। মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পবিত্র এ মাস। রমজান সিয়াম সাধনার মাস। এবার বাংলাদেশে রমজান মাস শুরু হয়েছে কাঠফাটা গরমে। সে জন্যে সেহরি থেকে ইফতার পর্যন্ত প্রায় ১৪ ঘন্টা সুস্থ্ থেকে রোজা পালন ও ইবাদত করতে পারা একটা চ্যালেঞ্জ।
একে তো গরম, তার ওপর রোজা রেখে দিন শেষে অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে সাহরি ও ইফতারের খাবারটা হওয়া উচিত সমৃদ্ধ ও পুষ্টিকর শরীরকে দৈনন্দিন কাজে কর্মক্ষম রাখা, অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে না পড়া এবং শরীরের পুষ্টির চাহিদা যাতে পূরণ হয়- সে দিকে নজর রেখে ইফতার, রাতের খাবার ও সাহরি এই তিনটি খাবারকে সাজাতে হবে।এবারের রমজান গ্রীষ্মকালে। আবহাওয়া বেশ উত্তপ্ত। এ সময় শরীর থেকে ঘামের মাধ্যমে প্রচুর পানি বের হয়ে যায়। সে জন্য পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন যাতে দেখা না যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের দৈনিক দুই থেকে আড়াই লিটার পর্যন্ত পানি পান করা প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনীয় পানি গ্রহণের ফলেই দেহে পানির ভারসাম্য ঠিক থাকে। রোজার সময় অনেকেরই পানিশূন্যতা দেখা যায়। কিন্তু যদি ইফতারির সময় থেকে সাহরি পর্যন্ত পানির চাহিদা পুরো মেটানো যায় তাহলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এজন্যই বোধ করি রমজান মাসে ইফতারের প্রথম উপাদান হিসেবে শরবতের প্রচলন হয়েছে। বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে শরবত তৈরি করা যায়। যেমন স্কোয়াশ, বিভিন্ন ফলের রস, সিরাপ, ইসপগুল, তোকমা, দুধ, দই, তেঁতুল, বেল, লেবু, লাচ্ছি ইত্যাদি। শরবত ছাড়াও পানির সমতা ঠিক রাখতে ইফতারে রাখা যেতে পারে ভেজানো চিড়া + দুধ/দই, দইবড়া, হালিম, ফালুদা, তাজা ফল ইত্যাদি। সন্ধ্যা রাতে ও সাহরিতে থাকতে পারে পাতলা ডাল, দুধ। পাতলা ঝোলের তরকারি রাখতে পারলে ভালো হয়। ইফতারির অন্যতম প্রধান উপাদান হলো ছোলা বা বুট ভাজা। এটি যেমন শক্তিবর্ধক, তেমনি এতে প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেটের চাহিদা ভালোভাবে মেটানো যায়। অবশ্যই চাহিদা অনুযায়ী খাওয়া উচিত। তা না হলে ওজন বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ছোলা ছাড়াও খাওয়া যায় চটপটি, ঘুগনি ইত্যাদি। এগুলোতে তেলের ব্যবহার তেমন হয় না বলে স্বাস্থ্যের দিক থেকে ভালো। এদিকে অন্যান্য উপাদানে তেলের ব্যবহার বেশি হয় বলে খাবারে ক্যালরির মাত্রা বেড়ে যায়। এজন্য যতটা সম্ভব তেল কমাতে পারলে ভালো হয়। সমন্বয় করার জন্য ইফতারির থালায় শুধু একটি বা দুটি তেলে ভাজা খাবার রাখা যেতে পারে।
একটি আদর্শ ইফতারির প্লেট
শরবত বা ডাবের পানি, কাঁচা ছোলা, কম তেলে ভাজা ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি অথবা আলুর চপ বা যে কোনো একটি তেলে ভাজা মুড়ি অথবা চিড়া এবং ফল। যেদিন হালিম অথবা খিচুড়ি খাওয়া হবে সেদিন বেসনের বা ডালের তৈরি ভাজা খাবার এবং মুড়ি বা চিড়া বাদ দিতে পারেন। আবার নুডলস অথবা ফ্রায়েড রাইস খেলেও মুড়ি অথবা চিড়া বাদ দিতে হবে। ইফতারির কাঁচা ছোলার সঙ্গে আদা কুচি, লবণ ও পুদিনা পাতা কুচি দিয়ে খাওয়া যায়। এটা হজমে যেমন সহায়ক, তেমনি ভিটামিন ও খনিজ লবণের ঘাটতি এতে দূর হবে। রমজানের সময় ইফতারিতে খেজুর একটি বিশেষ উপাদান হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রতিদিন অন্যান্য খাবারের সঙ্গে একটি বা দুটির বেশি খেজুর খাওয়ার তেমন প্রয়োজন নেই। কারণ, এতে ক্যালরি ও শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে। যদিও পর্যাপ্ত লৌহ খেজুর থেকে পাওয়া সম্ভব।
ইফতারে কী খাবেন
রোজা রাখার পর ইফতার প্রথম খাবার। তাই সেটা স্বাস্থ্যকর হওয়া প্রয়োজন। সাধারণত আমরা ইফতারে মুখরোচক, ভাজাপোড়া খাবার খেয়ে থাকি। এগুলোতে প্রচুর তেলের ব্যবহার হয়, যা শরীরে ট্রান্সফ্যাট তৈরি করে। যারা বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছেন, তাদের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও এসব খাবারে প্রচুর লবণ রয়েছে, যা শরীরকে পানিশূণ্য করে। অ্যাসিডিটি বাড়ায়, অস্বস্তি তৈরি করে। তাই, এধরণের খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো। এজন্য বাড়িতে তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবারের ওপর জোর দিতে হবে। যেমন চিকেন ফ্রাইয়ের বদলে বাসায় তৈরি গ্রিল চিকেন খাওয়া যেতে পারে। খাবারে কিছুটা শর্করা যোগ করতে হবে। সেটা হতে পারে চিড়ে, মুড়ি বা লাল আটার তৈরি একটা পাতলা রুটি, এমনকি সামান্য ভাতও হতে পারে। সেই সাথে অবশ্যই সবজি থাকতে হবে। সারাদিনে তিন থেকে চার পরিবেশনে সবজি খাওয়া উচিত। এক্ষেত্রেও আমরা সবজিকে তিনবারের খাবারে ভাগ করে খেতে পারি। প্রতিদিন বেগুনি বা ডুবোতেলে ভাজা না খেয়ে, সবজি দিয়ে তৈরি শ্যালো ফ্রাই করা চপ, সবজি-খিচুড়ি বা রুটি-সবজি থাকতে পারে খাদ্য-তালিকায়। পানি ও খেজুর হতে পারে ইফতার অনুসঙ্গ। তরল খাবারের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বাজারের রঙিন পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। এই গরমে ঘরে তৈরি লেবুর শরবত, বেলের শরবত, ডাবের পানি খুব দ্রুত শক্তি প্রদান করে এবং শরীরকে ঠান্ডা রাখে। অবশ্যই মৌসুমী ফল রাখতে হবে। ফল থেকে পাওয়া যায় ভিটামিন সি, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। রকমারি ফল ইফতারকে সমৃদ্ধ করবে। এই মৌসুমে যেসব দেশি ফল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো খেতে হবে। ফলের জুসের সাথে অতিরিক্ত চিনি না খাওয়াই ভালো। মাছ, মাংস বা ডিম দিয়ে তৈরি কোনো খাবার থাকতে পারে। সারাদিন রোজার পরে আমিষের অভাব পূরণ করবে। হালিমের বদলে সবজি খিচুড়ি খাওয়া ভালো।
রাতের খাবার
রাতের খাবার অবশ্যই খেতে হবে। রাতের খাবারে দুধ মুড়ি, দুধ ভাত, অথবা দুধের সাথে ওটস বা সিরিয়াল খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া ইফতারে বেশি ভারী খাবার না খেয়ে এ সময়টাতে পাতলা খিচুড়ি, রুটি-সবজি, ভাত, মাছ-মাংস, খাওয়া যেতে পারে। তারাবীহ নামাজের পর ডিনার করা ভালো।রোজার সময় সন্ধ্যারাতের খাবারের গুরুত্ব তেমন থাকে না। মনে হয়, খেতে হবে তাই খাওয়া। তারপরও কেউ যদি খেতে চান তাহলে যেন খাবার গুরুপাক ও বেশি হয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেহেতু ইফতারিতে ডালের তৈরি খাবার বেশি হয়, সেহেতু এ সময় ডাল বাদ দেওয়া যেতে পারে। এ সময় হালকা মশলায় রান্না করা মাছ ও সবজি থাকলে ভালো হয়। ইফতার ও সাহরিতে অনেক সময় সবজি খাওয়াটা বাদ পড়ে যায়। অনেকেই রমজানে সবজি একেবারেই পছন্দ করেন না। তাদের জন্য সন্ধ্যারাতেই সবজি খাওয়ার উপযুক্ত সময়। এ রাতে খাবারে ছোট মাছও রাখা যেতে পারে। সাহরির সময় কাঁটা বেছে মাছ খেতে অনেকেই বিরক্ত বোধ করেন
সাহরির খাবার
সাহরির খাবার গ্রহণ করার অবশ্যই একটি স্বাস্থ্যগত দিক রয়েছে। কারণ, যদি সাহরিতে খাবার না খান তাহলে অবশ্যই দুর্বল হয়ে পড়বেন। এতে ক্যালরির ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে এক মাস রোজা রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। সাহরির সময় না খেলে আমাদের দেহের বিপাকক্রিয়ায় বেশ পরিবর্তন আসতে পারে। এতে গ্লুকোজ ক্ষয় বেশি হয় বলে ক্লান্তি আসে। সাহরিতে ভাতই খেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। রুচি অনুযায়ী রুটি, পরাটা, দুধ, সেমাই ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। এ সময় মাংস ও ডিম খাওয়া সুবিধাজনক। এ সময়টাতে ঘন ডাল খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া ছোট-বড় সবার জন্যই এক কাপ দুধ খাওয়া উচিত। কারণ, খাবারে চাহিদামতো প্রোটিন বা আমিষ না থাকলে উপবাসের সময় শক্তির ঘাটতি দেখা দেবে। মোট কথা অন্যান্য দিনে যার যতটুকু ক্যালরির চাহিদা থাকে, ততটুকু ক্যালরি রমজানের তিন বেলার আহারে গ্রহণ করতে হবে। এর বেশিও নয়, আবার কমও নয়। রোজার সময় প্রত্যেকের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করেই মেন্যু ঠিক করা উচিত। আশার কথা এই যে, কিছুদিন আগে পর্যন্তও দেখা যেত যে কোনো অসুস্থতায় অনেকেই রোজা রাখাকে আতঙ্কজনক বলে ভাবতেন। বর্তমানে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদদের উপদেশ, আশ্বাস ও সহযোগিতার ফলে অসুস্থতা নিয়েও অনেকে নির্বিচ রোজা রাখতে পারছেন। ডায়াবেটিস থাকলে চিনি-মিষ্টি-গুড়-মধু, শরবত কিংবা অন্যান্য খাবার থেকে মিষ্টি বাদ দিতে হবে। পেপটিক আলসারের রোগী হলে ডুবো তেলে ভাজা এবং ঝাল খাবার বাদ দিতে হবে। তারা খেতে পারেন চিড়া, কলা, চিড়া-দই, মুগের ডালের নরম খিচুড়ি, নুডুলস ইত্যাদি। রক্তে কোলেস্টেরল বা ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বেশি থাকলে ইফতারিতে তেঁতুল ও রসুনের চাটনি খাওয়া যেতে পারে। যদি কোনো কারণে ডাল খাওয়া নিয়েও সমস্যা থাকে, তাহলে ইফতারিতে চালের গুঁড়া বা ময়দার বড়া এবং চিড়া, দই, নুডলস, ফ্রায়েড রাইস খাওয়া যেতে পারে। ওজন বেশি থাকলে তেলের পরিমাণ কমাতে হবে এবং সম্পূর্ণ খাবার থেকে ক্যালরি কমাতে হবে। এদিকে যাদের ওজন কম তাদের জন্য ইফতারিই আদর্শ খাবার। সবশেষে বলা যায়, রমজান মাসে যে খাবারই গ্রহণ করুন না কেন, তা যেন সহজপাচ্য ও সীমিত হয়। কারণ, এ সময় অতিরিক্ত খাবার দেহের রাসায়নিক উপাদানের মধ্যে সূক্ষ্মভাবে পরিবর্তন আনে, ফলে রক্তের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। এতে শারীরিক দুর্বলতা অনুভূত হয়। অর্থাৎ বেশি খাবার খেয়েও কোনো লাভ হয় না। এমনভাবে খেতে হবে যাতে শরীর ভালো থাকে।
পানি খাওয়ার নিয়ম
ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত দুই থেকে আড়াই লিটার পানি খাওয়া উচিত। একটা নিজস্ব বোতল রাখতে হবে। ইফতারের সময় থেকে সেহরি পর্যন্ত ওই বোতলে পরিমাপ করে পানি খেতে হবে। ইফতারের পরপর কিছুটা পানি খেতে হবে। আবার তারাবীহর নামাজের পর এক দেড় লিটার পানি খাওয়া যেতে পারে। সাহরিতে একটু আগে খাবার খেয়ে ফযরের নামাজের আগ পর্যন্ত পানি খেলে, দুই থেকে আড়াই লিটার পানি প্রতিদিন খাওয়া সম্ভব। তাছাড়া শরবত ও অন্যান্য তরল তো খাওয়া হচ্ছেই।