হার্ট অ্যাটাক এর কারণ ও প্রতিকার
হার্ট অ্যাটাক সত্যিই একটি বিশেষ রোগ। এই রোগটি আসলে সবার মধ্যে খুব ভীতি সঞ্চার করে থাকে। এর কারণ হলো হার্ট অ্যাটাক রোগে যারা মৃত্যুবরণ করে তাঁদের বেশির ভাগ লোকই কিন্তু প্রথম ঘণ্টার মধ্যে মারা যান।
তাই হার্ট অ্যাটাক সম্বন্ধে আমাদের একটি ব্যক্তিগত ধারণা থাকা দরকার। এর কারণ হলো, হার্ট অ্যাটাক যেই রোগীর হয় তাঁকে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে রোগীর পাশে যাঁরা থাকেন তাঁদের কিছু বিষয় জেনে রাখা দরকার। তাঁদের কিছু দায়িত্ব থাকে।
আমরা সবাই জানি হার্ট আমাদের সারা শরীরের রক্ত সঞ্চালন করে পাম্পের মাধ্যমে। যেহেতু হার্ট নিজে একটি পাম্প, তাকে কাজ করতে হয়, তাই তার নিজস্ব একটি রক্ত চলাচলের পদ্ধতি রয়েছে, রক্তনালি আছে। এই রক্তনালিগুলো মধ্যে কোনো একটি বা একের অধিক নালি যদি হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে হার্টের বেশ কিছু অংশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে গেলে হার্টের কাজ করার ক্ষমতাও বন্ধ হয়ে যায়। এটিই হলো হার্ট অ্যাটাক। মূলত, রক্তনালি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে হার্টের কার্যক্ষমতা যে বন্ধ হয়ে গেল, সেটিই হলো হার্ট অ্যাটাক।
রোগীর কোন কোন লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে?
সাধারণত দুইভাবে বিষয়টি হতে পারে। কোনো কোনো লোকের হয়তো আগে থেকে কিছু কিছু লক্ষণ থাকে। যেমন : অনেকের হয়তো পরিশ্রম করতে গিয়ে বুকে ব্যথা হতো, বিশ্রাম করলে তিনি ভালো থাকতেন। এভাবে কয়েক মাস বা কয়েক বছরও চলে যেতে পারে। আবার কোনো কোনো লোকের ক্ষেত্রে হঠাৎ করেই হার্টের রগটি বন্ধ হয়ে যায়।
আসলে আগে থেকে রোগ থাকুক বা না থাকুক যদি কোনো কারণে হঠাৎ করে হার্টের রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, হার্টের রোগ হয়, একে সাধারণত হার্ট অ্যাটাক বলা হয়ে থাকে।
তবে যদি সামগ্রিকভাবে চিন্তা করি, হার্টের রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া, এই সম্পূর্ণ রোগটিকে সাধারণত বলা হয়ে থাকে, ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ। যেহেতু এই রোগের প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি এবং রোগটি ভয়াভহ, সেক্ষেত্রে সাধারণভাবে হৃদরোগ বলতে এই জিনিসকে বোঝানো হয়ে থাকে। যদিও এই জিনিসটির অন্য কারণও রয়েছে।
সাধারণত বুকে ব্যথা হওয়াটা সবচেয়ে প্রচলিত লক্ষণ। হঠাৎ করে বুকটা ভীষণ চেপে ধরে। মনে হয় বুকটি ভেঙ্গে পড়ল। অনেক ওজন চেপে গেছে। এটা হয় শুরুতে এবং এর সাথে সাথে অনেকের শরীরে ঘাম হতে থাকে। পাশাপাশি অনেক সময় মাথা ঘুরতে থাকে, বমি হতে থাকে। আবার বমি নাও হতে পারে। তবে বুকে ব্যথা হওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তার হয়তো আগে থেকে উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য কোনো রোগ ছিল, সেখান থেকে হার্ট অ্যাটাক হলো। এগুলোই তার প্রধান উপসর্গ।
এই সময়ে আমাদের করণীয় কী? এ রকম হলে তাৎক্ষণিকভাবে কী করব? তাহলে এই ধরনের লক্ষণ যদি দেখা যায়, আপনি ৯০ ভাগ নিশ্চিত হতে পারেন এখানে হার্ট অ্যাটাকের প্রক্রিয়া চলছে। সেই সময় সঙ্গে সঙ্গে এসপিরিন ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে। এটি ৩০০ মিলিগ্রামের পাওয়া যায়- এটি খেয়ে নিতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে।
এর কারণ প্রাথমিক চিকিৎসার মধ্যে প্রথম চিকিৎসা হলো, ব্যথাটাকে কমানো এবং সম্ভব হলে দ্রুত ইসিজি করে রোগ নির্ণয় করা। এর আরো একটি কারণ হলো, যত তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছাবে তত তাড়াতাড়ি তার চিকিৎসা শুরু হবে। আর যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু হবে, তত তাড়াতাড়ি হার্টের একটি বড় অংশ বাঁচানো সম্ভব হবে। বেশি অংশ ক্ষতি হওয়া থেকে বেঁচে গেলে হার্টটি মোটামুটিভাবে কাজ করতে পারবে- এটা হলো প্রধান উদ্দেশ্য দ্রুত রোগ নির্ণয় করার। এসপিরিন সম্ভব হলে খাওয়াতে হবে, খাওয়ানো যাক বা বা না যাক তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
হার্ট ব্লক এর কারণ
বিশ্বে প্রতি বছর ৩৮ লাখ পুরুষ এবং ৩৪ লাখ মহিলা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, তার মধ্যে প্রতি ৪ জনের একজনের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে করোনারি হার্ট ডিজিজ বা ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ যা মূলত এথোরোসক্লেরোসিস এর ফলাফল।
অল্পতেই দম ফুরিয়ে যাওয়া, মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়াও হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ। অতিরিক্ত ঘাম হওয়া: অতিরিক্ত ঘাম হওয়া হার্ট অ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ। বিশেষ করে ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা হওয়া ছাড়াও অতিরিক্ত ঘাম, বুক ধড়ফড়, হঠাৎ শরীর খারাপ লাগতে শুরু করলে অব্যশই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
হার্টের মাংশপেশী সমূহ সচল থাকার জন্য হার্টের মধ্যে রক্ত সরবরাহ হয় দুইটা রক্ত নালীর মাধ্যমে যাকে রাইট এন্ড লেফট করোনারি আর্টারি বলে। এই করোনারি আর্টারি সমূহে ফ্যাট কিংবা চর্বি জমে যদি রক্ত সঞ্চালনে বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে এই অবস্থাকে করোনারি আর্টারি ডিজিজ বলে এই অবস্থাকে আবার হার্ট ব্লক ও বলা হয় আর ফ্যাট জমে আর্টারি মোটা আর শক্ত হয়ে যাওয়াকে এথোরোসক্লেরোসিস বলে। এথোরোসক্লেরোসিস হলে যে কোনো মুহুর্তে রক্তনালি ছিড়ে রক্ত জমাট বেধে যেতে পারে। রক্তনালীর ভিতর যদি রক্ত জমাট বাধে তাহলে সেখানে রক্ত চলাচল করতে পারবে না, হার্টের রক্তনালীতে যদি রক্ত চলাচল করতে না পারে তাহলে হার্টের মাংসপেশি সমূহ অক্সিজেন পাবেনা, অক্সিজেন না পেলে হার্টের টিস্যু সমূহ ড্যামেজ হতে থাকবে এবং এইভাবে হার্টের রক্তনালীতে রক্তজমাট বাধার কারণে কিংবা শরীরের অন্য কোনো ধমনীতে রক্ত জমাট বেধে তা থ্রম্বোসিস হয়ে তথা রক্তনালী দিয়ে পরিবাহিত হয়ে যদি করোনারি আর্টারি সমূহকে কিংবা হার্টের ধমনী সমূহকে ব্লক করে দেয় এবং হার্টের পেশীসমূহে যদি পরিমিত অক্সিজেন দিতে না পারে তখন অক্সিজেনের অভাবে হার্টের টিস্যু সমূহ ড্যামেজ হয়ে যাবে যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাক বলা হয়।
এই সময় খুব দ্রুত রক্ত সরবরাহ চালু করতে না পারলে মৃত্যু হতে পারে। এই সময় রোগীর প্রচন্ড বুকে ব্যাথা হবে, সাথে শ্বাসকষ্ট হবে, শরীর ঘামিয়ে যাবে, ব্যাথা ঘাড়, হাত, পিঠে বা থুতনিতে যেতে পারে।
ইশকেমিক হার্ট ডিজিজের উপসর্গ:
ব্লাড প্রেশার চেক করা না হলে অধিকাংশ রোগী উপসর্গহীন থাকে এবং এক সময় তারা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করে মৃত্যু বরণ করে। আর কারো কারো ক্ষেত্রে নিম্নের কিছু উপসর্গ দেখা দেয়:
১। চলতে ফিরতে বুকে ব্যাথা হয়
২। শ্বাসকষ্ট হয়
৩। খাবার পরে বুকে ব্যাথা হয়,
৪। একটু টেনশন করলে বুকে ব্যাথা হয়,
৫। মাথা ঘোরানো এবং মাথা ব্যাথা
৬। ঘাড় কিংবা বাহুতে ব্যাথা
৭। বমি বা বমির ভাব
ইসকেমিক হার্ট ডিজিজের কারণ:
১। উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন
২। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার যথা গরুর গোশত, ডিম বা ট্রান্স ফ্যাট জাতীয় খাবার ইত্যাদি
৩। সিগারেট স্মোকিং বা জর্দা ইত্যাদি
৪। অবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজন
৫। এলকোহল, কোমল পানীয়
৬। পর্যাপ্ত ব্যায়াম না করা
৭। শারিরীক পরিশ্রম না করা
৮। সবসময় শুয়ে থাকা ইত্যাদি।
ইসকেমিক হার্ট ডিজিজের কারণে জটিলতা:
১। হার্ট অ্যাটাক হতে পারে
২। ব্রেইন স্ট্রোক হতে পারে
প্রতিকার:
১। ধূমপান ত্যাগ করতে হবে
২। ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
৩। ওজন স্বাভাবিক বিএমআই অনুযায়ী রাখা জরুরি। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৪। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে এবং লবণ কম খেতে হবে।
৫। নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত
৬। স্বাভাবিক শারীরিক পরিশ্রম করা উচিত।
চিকিৎসা:
১। লাইফস্ট্যাইল মোডিফাই করতে হবে এবং অতিরিক্ত ওজন কমার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
২। ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সে জন্য নিয়মিত রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত খেয়ে যেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া মেডিসিন বাদ দেয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে খুব খেয়াল রাখতে হবে। কোন মেডিসিন যেন খেতে ভুলে না যায়। এছাড়া যে কোন জটিলতায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বুকে ব্যাথা হলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে।