দাঁতের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়
ব্যক্তির সৌন্দর্যের অনেকখানি নির্ভর করে সুন্দর হাসির ওপর। আর সুন্দর হাসি নির্ভর করে সুস্থ ও সুন্দর দাঁতের ওপর। সৌন্দর্য ছাড়া শারীরিক সুস্থতার জন্যও দরকার সুস্থ দাঁত।
শুধু সঠিক সময়ের সঠিক যত্ন ও পরিচর্যাই পারে সুস্থ দাঁতের নিশ্চয়তা দিতে। সময়মতো দাঁতের যত্ন নেবেন না, আর বলবেন, দাঁত হলুদ হয়ে গেছে, মাড়ি ফুলে গেছে, দাঁতে প্রচণ্ড ব্যথা কিংবা বয়স হয়েছে! দাঁত তো পড়বেই। মনে রাখবেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে দাঁত নড়ার বা পড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক সঠিক পরিচর্যার সঙ্গে। সঠিক পরিচর্যার অভাবে দাঁতের স্বাস্থ্য সমস্যা প্রাথমিকভাবে হালকা ব্যথা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে তীব্র ব্যথায় রূপ নেয়।
দাঁতের ব্যথা কেন হয় এবং এড়াতে কী করবেন?
খাবারের পর দাঁতের ফাঁকে খাদ্যকণা জমে। বিশেষ করে আঠালো, শর্করা ও মিষ্টিজাতীয় খাবার হলে তো কথাই নেই। এসব খাদ্যকণা মুখের মধ্যে থাকা নানা ব্যাকটেরিয়া বা ওরাল ফ্লোরার আবাস ও বংশবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত স্থান। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এই খাদ্যকণায় পচন ধরে এবং লেকটিক অ্যাসিড নামের একধরনের অ্যাসিড নির্গত হয়। এ সময় মুখে দুর্গন্ধ হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি অ্যাসিড ধীরে ধীরে দাঁতের এনামেল এবং আরও পরে ডেন্টিনকে ক্ষয় করে, যাকে আমরা বলি দাঁতক্ষয় বা ডেন্টালক্যারিজ। এভাবে দাঁত ক্ষয় হয়ে দাঁতের মধ্যে গর্ত বা ক্যাভিটি তৈরি হয়, যেখানে সহজেই ময়লা ও খাদ্যকণা জমে সংক্রমণ ও ক্ষয় আরও দ্রুত হয়। এ ক্ষয়প্রক্রিয়া যখন দাঁতের মজ্জা বা পাল্প পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন দাঁতের পাল্পে একধরনের প্রদাহ তৈরি হয় এবং তীব্র ব্যথা ও শিরশির অনুভূতি শুরু হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষায় একে আমরা ‘পাল্পাইটিস’ বলি।
সাপ্পোরো ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক স্পিনা লুনা বিশ্বাস বলেন, ইনফেকশন বা প্রদাহ বাড়তে থাকলে পেরিয়াপিক্যাল ইনফেকশন, পরবর্তীকালে পেরিয়াপিক্যাল অ্যাবসেস, পেরিয়াপিক্যাল গ্র্যানিওলোমা এবং পেরিয়াপিক্যাল সিস্ট তৈরি হয়। পেরিয়াপিক্যাল ইনফেকশন ও অ্যাবসেস একুইট কন্ডিশন হওয়ায় ব্যথা খুব তীব্র হয়। অন্যদিকে পেরিয়াপিক্যাল অ্যাবসেস ও সিস্ট মোটামুটি ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় ব্যথা তত তীব্র না হলেও সারাক্ষণ একটা ভারী ব্যথা অনুভূত হয়। এ ইনফেকশন যদি কোনো একপর্যায়ে চোয়ালের হাড়ে পৌঁছায়, তখন অস্টিওমায়লাইটিস হয় এবং ব্যথা অনুভূত হয়।
বাহ্যিক কোনো আঘাতের কারণে দাঁত ভেঙে গিয়ে কিংবা রুট ক্যানেল চিকিৎসার জন্যও গর্ত হতে পারে এবং সেখানে খাদ্যকণা জমে সংক্রমণ হয়ে তীব্র ব্যথা হতে পারে। আবার এসব কারণে যদি অ্যাপেক্স নার্ভ ইনজুরি বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাতেও তীব্র ব্যথা হতে পারে।
কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশন বা আঘাতের কারণে যদি চোয়ালের ট্রাইজেমিনাল নার্ভ আক্রান্ত হয়, তবে ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া হয় এবং তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।
তা ছাড়া অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং আয়রন ও বি-কমপ্লেক্সের দীর্ঘমেয়াদি ঘাটতিতে মুখ গহ্বর ও দাঁতের মাড়ি সংক্রমিত হয়ে অ্যাবথাস আলসার হয়, যা তীব্র ব্যথার উদ্রেক করতে পারে।
কাজেই সুস্থ দাঁতের জন্য বা দাঁতের ব্যথা এড়ানোর জন্য নিয়মিত ব্রাশ করার পাশাপাশি ফ্লস বা সুতা দিয়ে প্রতিটি দাঁতের ফাঁকের খাদ্যকণাগুলো বের করে ফেলুন। এতে যেমন মুখে দুর্গন্ধ হবে না, তেমনি দাঁতের ক্ষয়ও এড়ানো যাবে। প্রতিদিন সকালে নাস্তার পর ও রাতে খাবার খাওয়ার পর দুবার সঠিকভাবে দুই মিনিট ধরে দাঁত ব্রাশ করতে হবে।
প্রতিদিন অন্ততপক্ষে একবার জীবাণুনাশক মাউথওয়াশ দিয়ে অথবা এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে এক চিমটি লবণ মিশিয়ে মুখ কুলিকুচি করুন। এতে দাঁতের ক্ষয় ও মাড়ির রোগ বেশির ভাগই প্রতিরোধ করা যায়। বাঁকা দাঁতে বেশি ময়লা জমে। তাই সময় নিয়ে (দুই থেকে তিন মিনিট) দাঁত ব্রাশ করুন এবং প্রতিবার খাবার খাওয়ার পর পানি দিয়ে কুলিকুচি করুন।
সুস্থ দাঁতের জন্য করণীয়
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বর্তমান উৎকর্ষতায় কিছু করণীয় নিয়মিত পালন করলে দাঁত ও শরীর দুটিই সুস্থ থাকবে। স্মাইল ডেন্টাল ক্লিনিকের ডেন্টাল সার্জন কানিজ ফাতেমা মুন বলেন, ‘দাঁত সুস্থ না থাকলে আমরা আমাদের চাহিদামাফিক খাবার যেমন খেতে পারি না, তেমনি ঠিকঠাক না চিবানোর জন্য হজমে সমস্যা হয়। ফলে শরীরও তার প্রয়োজনীয় খাদ্যমান পায় না। কাজেই সুস্থ ও সবল দাঁতের জন্য নিচের করণীয়গুলো পালন করুন—
১. বছরে অন্তত দুবার একজন অভিজ্ঞ ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ নিন এবং আপনার দাঁতের চেকআপ করান। এতে দাঁতের ক্যারিজ ও মাড়ির রোগ অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
২. স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস রপ্ত করুন। মনে রাখবেন দাঁতে আঠার মতো আটকে থাকে, এমন সব খাবার সহজে দাঁতের ক্ষতি করে। কাজেই চকলেট, চুইংগাম, বিস্কুট, ফাস্টফুড, মিষ্টি, কোমল পানীয়—যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলুন। অতিরিক্ত টকজাতীয় খাবার, যেমন লেবু, তেঁতুল দাঁতের সংস্পর্শে যত কম রাখা যায়, ততই ভালো।
৩. ধূমপান, জর্দা, পান-সুপারি, তামাক ও গুল স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক।
তথ্যসুত্রে: প্রথম আলো