পায়ুপথের রোগ মানেই পাইলস নয়
পায়ুপথের রোগ মানেই পাইলস নয় সে সর্ম্পকে প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন অধ্যাপক ডা. মো. আতিয়ার রহমান।
পায়ুপথের যেকোনো রোগকেই বেশির ভাগ মানুষ পাইলস বলে জানে। কিন্তু পায়ুপথের রোগ মানেই পাইলস নয়। নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে পায়ুপথে। বেশির ভাগ রোগী, বিশেষত নারীরা, এসব সমস্যা গোপন করে রাখেন এবং চিকিৎসা গ্রহণ করতে দেরি করে ফেলেন। আবার অনেকেই লজ্জা বা সংকোচের কারণে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে টোটকা ওষুধ, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি গ্রহণ করেন। আর ক্রমশ অবস্থা জটিল হয়ে পড়ে।
কিন্তু সময়মতো চিকিৎসা নিলে অধিকাংশ মানুষ সার্জারি বা অস্ত্রোপচার ছাড়াই হয়তো ভালো থাকতেন।
পায়ুপথে সাধারণত ফিসার, ফিস্টুলা, হেমোরয়েড, ফোড়া, প্রোলাপস, রক্ত জমাট, পলিপ বা টিউমার ইত্যাদি রোগ হতে পারে। সব সমস্যার অন্যতম কারণ হলো কোষ্ঠকাঠিন্য। তাই এ বিষয়ে আগে থেকে সচেতন ও সতর্ক থাকতেই হবে। চিকিৎসা না নিলে এ থেকে কখনো কখনো ক্যানসার বা বড় সমস্যাও দেখা দিতে পারে। তাই যথাসময়ে এর চিকিৎসা ও সতর্কতা জরুরি।
পায়ুপথের কিছু পরিচিত সমস্যা
ফিসার
কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে পায়ুপথের সামনে বা পেছনে ফেটে গিয়ে ক্ষত তৈরি হলে তাকে ফিসার বলে। বাংলায় বলে ভগন্দর। এই সমস্যায় তীব্র বা মাঝারি ব্যথা ও জ্বালাপোড়া হয়। মলত্যাগের সময় সামান্য রক্ত যায়। পায়ুপথ সরু হয়ে আসে। অনেক দিন ধরে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের অস্ত্রোপচারের দরকার হয়। প্রাথমিক অবস্থায় খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, জিটিএন মলম ব্যবহার, পভিসেপ লোশন মেশানো কুসুম গরম পানিতে সেঁক দিলে ভালো থাকা যায়।
পাইলস
চিকিৎসকেরা একে বলেন হেমোরয়েড। বাংলায় অর্শ। পাইলস ক্রমান্বয়ে আকারে বেড়ে গিয়ে নিচে নেমে আসে। পায়ুপথকে ঘড়ির সঙ্গে তুলনা করলে ৩টা, ৭টা ও ১১টার কাঁটার জায়গায় তিনটি রক্তের শিরা কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে চাপ খেয়ে ফুলে ক্রমশ নিচের দিকে নামতে থাকে। এর পাঁচটি পর্যায় আছে। পাইলস ব্যথাহীন হলেও প্রচুর রক্তপাত হতে পারে। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, মল নরম করার ওষুধ এবং কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ দিয়ে প্রথম পর্যায়ের পাইলস সারানো সম্ভব। দ্বিতীয় পর্যায়ের পাইলসে ব্যান্ড লাইগেশন খুবই কার্যকর অস্ত্রোপচার। তৃতীয় ও চতুর্থ মাত্রার পাইলসে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পাইলসগুলো কেটে ফেলা হয়।
ফোড়া
পায়ুপথের ভেতরে ও বাইরে ছোট-বড় নানা ধরনের ফোড়া হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এর অন্যতম কারণ। ফোড়ার অস্ত্রোপচার না করলে এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরে ফিস্টুলা হওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি।
ফিস্টুলা
ফিস্টুলা হলো একটি ঘা, যার একটি মুখ পায়ুপথের বাইরে, অপরটি ভেতরে থাকে। ফোড়া হওয়ার কারণে এটি হয়। এরও চিকিৎসা অস্ত্রোপচার। তবে নালির ভেতরের মুখ যদি খুব ওপরে হয় বা আঁকাবাঁকা হয়, তবে অস্ত্রোপচার ব্যর্থ হতে পারে। কাজেই অস্ত্রোপচারের আগে ফিস্টুলোগ্রাম, এমআরআই করে নেওয়া ভালো।
প্রোলাপস
পায়ুপথ দিয়ে অনেক সময় বৃহদন্ত্রের কোনো অংশ আংশিক বা পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারে। একে প্রোলাপস বলে। ল্যাপারোস্কপি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এর চিকিৎসা করা যায়।
হেমাটোমা
কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে পায়ুপথের রক্তনালি ফেটে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। কখনো কখনো প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি জটিল হয়ে গেলে অস্ত্রোপচার করা লাগতে পারে।
সচেতন হোন
কোষ্ঠকাঠিন্য যাতে না হয়, সে বিষয়ে সতর্কতা উচিত শুরু থেকেই। অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে মলত্যাগ করা উচিত নয়। বারবার মলত্যাগের অভ্যাস ত্যাগ করা এবং ডায়রিয়া হলে দ্রুত চিকিৎসা করা উচিত।
ওপরের সমস্যাগুলো দেখা দিলে দেরি না করে বা সংকোচ না করে চিকিৎসা শুরু করে দিলে বিনা অস্ত্রোপচারেই ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রোগীকে খাবারদাবারেও পরিবর্তন আনতে হবে। কোষ্ঠকাঠিন্য হয় এমন খাবার না খাওয়াই ভালো, যেমন অতিরিক্ত ভাজাপোড়া, অতিরিক্ত তেল-চর্বি, গরু, চিংড়ি, গুরুপাক ও বাসি খাবারদাবার বর্জন করা উচিত।
পায়ুপথের সমস্যায় বেশি ব্যথা হলে কোনো কোনো সময় ব্যথানাশক ওষুধও ব্যবহার করা যেতে পারে। সিজ বাথ (কটি পর্যন্ত ডুবিয়ে বসা যায় এ রকম ছোট স্নানের টব) নিলে উপকার হয়। এটির নিয়ম হচ্ছে আধা গামলা লবণমিশ্রিত হালকা গরম পানির মধ্যে নিতম্ব ১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হয়। স্থানিক অবশকারী মলম ব্যবহারে উপকার পাওয়া যায়। এতে যদি পুরোপুরি না সারে এবং রোগটি যদি বেশি দিন চলতে থাকে, তাহলে অপারেশন ছাড়া ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম।
শল্য চিকিৎসা
পায়ুপথের নানা সমস্যায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য বেশির ভাগ সার্জন অপারেশনের বিপক্ষেই থাকেন। কারণ, এতে কোনো কোনো রোগীর মল আটকে রাখার ক্ষমতা ব্যাহত হতে পারে। অস্ত্রোপচার ছাড়াও নানা রকম আধুনিক চিকিৎসা আছে, যা এখন বাংলাদেশেই সহজলভ্য।
যেমন পায়ুপথ বা মলদ্বারের স্ফিংটারে অস্ত্রোপচার। এই অস্ত্রোপচারে মলদ্বারের অভ্যন্তরীণ স্ফিংটার মাংসপেশিতে বা বিভিন্ন রকমফের সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার করতে হয়। রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া দুই দিনের মধ্যেই রোগী বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। অস্ত্রোপচারের তিন দিন পর স্বাভাবিক কাজকর্ম করতেও পারেন। তাই ভয় বা আতঙ্কিত না হয়ে এ জটিল রোগটি যেন না বাড়ে এমনটি মাথায় রাখা উচিত সবার, প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ পায়ুপথ শল্যবিদের (সার্জন) পরামর্শ নেওয়া উচিত।
লেখক: কলোরেক্টাল ও ল্যাপারোস্কপিক সার্জন (অব.), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা