বর্তমান সময়ে শিশুর জ্বর হলে কী করবেন
বর্তমান সময়ে শিশুর জ্বর হলে কী করবেন সে সর্ম্পকে প্রথমআলো পত্রিকায় লিখেছেন অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বিভাগীয় প্রধান, শিশুরোগ বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা।
বর্তমান সময়ে পরিবারের কোনো সদস্যের জ্বর হলে কমবেশি সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন, আর জ্বরে আক্রান্ত সে সদস্য শিশু হলে তো কথাই নেই। করোনা মহামারির সময়ে কোনো শিশুর জ্বর হলে করোনার আশঙ্কাসহ নানা আতঙ্ক ভর করছে। ডেঙ্গু সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর আশঙ্কাও মাথায় রাখতে হচ্ছে।
তবে মনে রাখবেন, করোনা কিংবা ডেঙ্গুর বাইরে আগে থেকেই শিশুদের জ্বরের পেছনে অন্য যেসব রোগ ছিল, তা কিন্তু এখনো আছে। তাই শিশুর জ্বর হলে করোনা বা ডেঙ্গুর পাশাপাশি তা যেকোনো সংক্রমণের আশঙ্কা নিয়েও ভাবতে হবে।
গড়পড়তা প্রতিবছর অন্য অনেক ভাইরাসের সংক্রমণেও শিশুদের জ্বর হয়। যেমন শিশুর জ্বরের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে আছে টাইফয়েড, টনসিলে সংক্রমণ, কানে সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, রক্ত আমাশয়, প্রস্রাবে সংক্রমণ, ম্যালেরিয়া, মেনিনজাইটিস, এনকেফেলাইটিস, হার্টে সংক্রমণ ইত্যাদি।
জ্বরের কারণ হিসেবে করোনা ও ডেঙ্গু নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে বলে সাধারণ মানুষের ভেতর এ দুটি রোগ সম্পর্কে সবার মোটামুটি একটা ধারণা হয়েছে। আমরা আজ জ্বরের অন্য কারণগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
টাইফয়েড
টাইফয়েড শিশুদের জ্বরের অন্যতম কারণ, যা সালমোনেলা নামের এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া দিয়ে হয়। এই জীবাণু দূষিত খাবার বা পানীয়ের মাধ্যমে মানুষের অন্ত্রে ঢোকে। প্রবেশ করার পর নাড়িতে জীবাণুর বংশবিস্তার হয়, প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং একপর্যায়ে রক্তের মাধ্যমে এই জীবাণু শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। রোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা জ্বর যাতে শিশুরা খুব দ্রুতই অসুস্থ হয়ে যায়, ঠোঁট, জিহ্বাসহ পুরো শরীর যেন শুষ্ক হয়ে যায়। অনেক সময় জ্বরের সঙ্গে পাতলা পায়খানা হতে থাকে, পেট ফেঁপে যায়। খুব দ্রুত চিকিৎসা শুরু না করলে অনেক জটিলতা হতে পারে।
নিউমোনিয়া
শিশুদের জ্বরের একটা জরুরি কারণ হলো নিউমোনিয়া, যা ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এখানে জ্বরের সঙ্গে থাকে শ্বাসকষ্ট ও কাশি এবং রোগটি মারাত্মক হলে শিশুর শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি পড়ে। বাংলাদেশে শিশুদের জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টের প্রধানতম কারণ এখনো নিউমোনিয়া—এটা ভুলে গেলে চলবে না।
টনসিলে সংক্রমণ
গলার ভেতর দুপাশে এই অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ নানাবিধ রোগজীবাণুর প্রধান লক্ষ্য। সংক্রমিত হলে জ্বরের পাশাপাশি গলাব্যথা, মুখ দিয়ে লালা ঝরা, ঢোঁক গিলতে অসুবিধাসহ নানা সমস্যা হয়ে থাকে। একটা কথা এখানে বলা জরুরি, বারবার ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ কিন্তু বাতজ্বরের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।
কান পাকা
শিশুদের বিশেষ করে যারা বোতলে দুধ খায়, ঘুমের ঘোরে দুধ খায়, তাদের জন্য কানে সংক্রমণ বা কান পাকা আরেকটা পরিচিত সমস্যা। কানের এই সংক্রমণ ব্যাকটেরিয়াজনিত এবং আক্রান্ত শিশু জ্বরের সঙ্গে কানে প্রচণ্ড ব্যথার জন্য শিশু অবিরাম কাঁদতে থাকে এবং একসময় কানের পর্দা ফেটে কান দিয়ে পুঁজ রক্ত আসা শুরু হলে, তখন আস্তে আস্তে ব্যথা কমে যায় এবং জ্বরও কমে যায়।
রক্ত আমাশয়
শিশুদের নাড়িতে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে জ্বরের পাশাপাশি শিশুর পেটব্যথা, পাতলা পায়খানা এবং সঙ্গে রক্তপাত আমাশয়ের লক্ষণ।
প্রস্রাবে সংক্রমণ
এটাও শিশুদের জ্বরের অন্যতম কারণ। কোনো কারণে প্রস্রাবের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হলে যেমন প্রস্রাব অনেকক্ষণ চেপে রাখলে, কোষ্ঠকাঠিন্য হলে এই সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যায়। কখনো কখনো জ্বর তীব্র হয় এবং প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হয়, শিশু প্রস্রাব করতে কাঁদে, তলপেটে ব্যথা হয়।
মেনিনজাইটিস, এনকেফেলাইটিস
শিশুদের মস্তিষ্ক ও তার পর্দায় ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ হলে এই দুটো রোগ হয়। এখানে জ্বরের পাশাপাশি শিশুর বমি, খিঁচুনি হয় এবং অজ্ঞান হয়ে যায়। ঘাড় শক্ত হয়ে যায়।
জ্বরের পাশাপাশি খেয়াল রাখবেন
- শিশুর ঠিকমতো প্রস্রাব হচ্ছে কি না এবং তার পরিমাণ ও রং কেমন। একনাগাড়ে ৮ ঘণ্টা প্রস্রাব না হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন
- শরীরে কোনো ফুসকুড়ি উঠেছে কি না
- শিশুর প্রাণচাঞ্চল্য কেমন, ঝিমুনি ভাব বা নির্জীব হয়ে আছে কি না
- ঢোঁক গিলতে কষ্ট হচ্ছে কি না বা মুখ দিয়ে লালা ঝরছে কি না
- বুকের ওঠানামা, বুকের নিচের অংশ শ্বাস নেওয়ার সময় দেবে যাওয়ার মতো কিছু দেখা যায় কি না
- শিশু ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে কি না
- কান দিয়ে রস, পুঁজ বের হচ্ছে কি না
- খিঁচুনি হচ্ছে কি না
- মলের সঙ্গে রক্তপাত
- বমি কতবার, পরিমাণ
- নাক বা দাঁতের গোড়া দিয়ে রক্তপাত
- কোনো গিরা ফুলছে কি না
কোনো একটা লক্ষণ দেখলে দেরি না করে নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হতে পারে।
শিশুর জ্বর হলে কী করবেন
- জ্বর ১০০ ডিগ্রির বেশি হলে নির্দিষ্ট মাত্রার প্যারাসিটামল দিতে হবে। যেমন ৯ থেকে ১০ কেজি একজন শিশুর জন্য দেড় চামচ করে। সাপোজিটরিও দেওয়া যায়। জ্বর দ্রুতগতিতে নামানোর জন্য এর বাইরে ব্যথানাশক বা অন্য কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না।
- যে শিশুরা জ্বর খিঁচুনিতে ভোগে, তাদের জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি ঠেকাতে প্যারাসিটামলের পাশাপাশি চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ডায়াজিপাম খাইয়ে দিতে হবে।
- হালকা গরম পানিতে গামছা বা তোয়ালে ভিজিয়ে মাথাসহ পুরো শরীর ভালোভাবে মুছে দিতে হবে। ঠান্ডা পানি, বরফ দেওয়া পানি, মাথায় ক্রমাগত পানি ঢালা ইত্যাদির দরকার নেই। একই সঙ্গে ঘরের ফ্যান ছেড়ে দিলে তা জ্বর কমাতে সাহায্য করে।
- এ সময় শিশুর খাবারদাবার নিয়ে জোর করা যাবে না, তাতে বমি হতে পারে। শিশুকে প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার একটু বেশি দিতে হবে।
- জ্বরের শিশুর খাবারের চেয়ে তরল খাবার যেমন পানি, শরবত, ডাবের পানি, ফলের রস ইত্যাদি অল্প অল্প করে খাওয়াতে হবে। আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুর জন্য খাওয়ার স্যালাইন খাওয়ানো জরুরি।
- আন্দাজে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করবেন না।
- এই সময় যেহেতু ডেঙ্গু ও কোভিড বেশি হচ্ছে, তাই জ্বরের দু–এক দিনের মাথায় এই দুটির নমুনা পরীক্ষা, সঙ্গে সিবিসি করে ফেলা ভালো। তারপর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা।