মেদ, ভুঁড়ি কীভাবে কমাবেন
মেদ, ভুঁড়ি কীভাবে কমাবেন সে সর্ম্পকে প্রথমআলো পত্রিকায় লিখিছেন তানজিনা হোসেন সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড মেটাবলিজম বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা।
স্থূলতা ও ওজনাধিক্য বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বড় স্বাস্থ্য সমস্যা। নগরায়ণ, কায়িক শ্রমের অভাব, খাদ্যাভ্যাসে বিপুল পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী স্থূলতার হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর স্থূলতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রোগগুলো, যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্থূলতা বা ওবেসিটিকে একটি গুরুতর রোগ হিসেবেই ধরা হয়। আর বলা হয় এর যথাযথ সময়ে চিকিৎসার কথা।
আপনি কি স্থূল
একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বা নারীর আদর্শ ওজন কত হওয়া উচিত, তা জানতে বিএমআই বা বডি মাস ইনডেক্সের পরিমাপ ব্যবহার করা হয়। ওজনকে (কিলোগ্রামে) উচ্চতার (মিটারে) দ্বিগুণ বা বর্গ (স্কয়ার) দিয়ে ভাগ করলেই এই বিএমআইয়ের হিসাব পাওয়া যায়। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক বিএমআই হলো ১৮ দশমিক ৫ থেকে ২৪ দশমিক ৯ পর্যন্ত। বিএমআই ২৫–এর ওপর হলে সেটি ওভারওয়েট বা ওজনাধিক্য। বিএমআই যদি ৩০–এর ওপর হয়, তবে সেটি ওবেস বা স্থূল। আর ৪০–এর ওপর বিএমআই হলে তা মরবিড ওবেস বা গুরুতর রকমের স্থূল বলা যায়।
স্থূলতার আরেকটি পরিমাপ হলো পেটের মাপ বা ওয়েস্ট সারকামফেরেন্স। এশীয় পুরুষদের পেট বা ভুঁড়ির মাপ ৯০ সেন্টিমিটারের বেশি আর নারীদের ৮০ সেন্টিমিটারের বেশি হলে তাকে স্থূল ধরা হয়। এশীয়দের কম উচ্চতার জন্য বিএমআই স্বাভাবিক থাকলেও পেটের মাপ প্রায়ই বেশি পাওয়া যায়। আর এই উদরের চর্বি বা অ্যাবডোমিনাল ফ্যাট নানা রকমের রোগের জন্য দায়ী।
কেন ওজন বাড়ে
ওবেসিটি বা ওজন বাড়ার পেছনে মূল কারণ হলো ক্যালরি গ্রহণ আর ক্যালরি ক্ষয়ের মধ্যে অসামঞ্জস্য। আমরা দৈনিক যত ক্যালরি খেয়ে থাকি, সে অনুযায়ী খরচ না করলে বা পরিশ্রম না করলে সেই অতিরিক্ত ক্যালরি মেদ বা চর্বি হিসেবে দিন দিন জমা হতে থাকে।
দ্রুত নগরায়ণ আর যন্ত্রনির্ভরতার কারণে কায়িক পরিশ্রম কমছে মানুষের, অপর দিকে বাড়ছে উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার (ফাস্ট ফুড, ডেজার্ট, কোমল পানীয়) গ্রহণের প্রবণতা। শৈশব থেকেই মন্দ খাদ্যাভ্যাস আর কম পরিশ্রম
স্থূলতার ঝুঁকিতে ঠেলে দিচ্ছে বর্তমান বিশ্বের মানুষকে। এ ছাড়া খেলাধুলার স্থানের অভাব, অফিসে দিনমান টেবিলে বসে কাজ, কম্পিউটার-সেলফোন বা গাড়ি লিফটের প্রতি অতিনির্ভরতা, স্ট্রেস ইত্যাদি পরোক্ষভাবে স্থূলতার জন্য
দায়ী।
কিছু হরমোনজনিত রোগ স্থূলতার জন্য দায়ী হতে পারে। যেমন শরীরে স্টেরয়েড হরমোনের আধিক্য (কুশিং সিনড্রোম), হাইপোথাইরয়েডিজম, পলিসিস্টিক ওভারি ডিজিজ ইত্যাদি।
কিছু ওষুধ দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণেও ওজন বাড়ে। যেমন স্টেরয়েড–জাতীয় ওষুধ, ইনসুলিন, ডায়াবেটিসের সালফোনিল ইউরিয়া ওষুধ, অ্যান্টিসাইকোটিক গ্রুপের কিছু ওষুধ, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ইত্যাদি। কিছু জিনগত রোগে (যেমন প্রেডার উইলি সিনড্রোম) আক্রান্ত ব্যক্তি অস্বাভাবিক রকম স্থূল হতে পারে।
স্থূলতার সমস্যা
টাইপ–২ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, স্ট্রোক বা পক্ষাঘাত ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি বাড়ায় শরীরের মেদ। স্থূলতার কারণে হাঁটুতে অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা কোমরে ব্যথা হয়। স্লিপ এপনিয়ার প্রধানতম কারণ হলো স্থূলতা। এমনকি ব্রেস্ট ক্যানসার, কোলন ক্যানসারসহ বেশ কিছু ক্যানসারের পেছনেও স্থূলতাকে দায়ী করা হয়। পিত্তথলিতে পাথর, ইনফারটিলিটি বা বন্ধ্যত্ব, ডিপ্রেশন ইত্যাদি সমস্যার সঙ্গেও স্থূলতার সম্পৃক্ততা রয়েছে।
কেবল ওজন কমানোর মাধ্যমে অনেক রোগের ঝুঁকি কমানো যায়। বিজ্ঞানীরা বলেন, ৫ থেকে ১০ শতাংশ ওজন কমাতে পারলেই আপনার রক্তচাপ, রক্তের শর্করা ও রক্তের চর্বির অভাবনীয় উন্নতি দেখতে পাবেন। কমে যাবে ক্যানসারের ঝুঁকিও।
স্থূলতার চিকিৎসা
বিএমআই ৩০–এর বেশি হলে ওজন কমাতে খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা নিতে পারবেন। তবে কারও যদি কো-মরবিডিটি থাকে (যেমন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদ্রোগ, স্লিপ অ্যাপনিয়া) তাহলে বিএমআই ২৭–এর ওপরও এই চিকিৎসা শুরু করা যেতে পারে।
ওবিসিটির তিন ধরনের চিকিৎসা স্বীকৃত। মুখে খাবার ওষুধ, ইনজেকশন আর সার্জারি। কয়েক রকমের মুখে খাবার ওষুধ (যেমন ওরলিস্ট্যাট, টপিরামেট, বুপ্রোপ্রিওন ইত্যাদি) এফডিএ দ্বারা স্বীকৃত। লিরাগ্লুটাইড, সিমাগ্লুটাইড ইত্যাদি ইনজেকশন আকারে ব্যবহৃত হয়—এগুলো আসলে গ্লুকাগন লাইক পেপটাইড নামের হরমোন গোত্রের ওষুধ।
বিএমআই ৪০–এর বেশি কিংবা আনুষঙ্গিক রোগ থাকলে বিএমআই ৩৫–এর বেশি হলেও ব্যারিয়াট্রিক সার্জারি করা যাবে। বাংলাদেশে এ ধরনের শল্যচিকিৎসা শুরু হয়েছে।
ওজন কমাবেন কীভাবে
দৈনিক ক্যালরি গ্রহণ কমিয়ে আর ক্যালরি ক্ষয় বাড়িয়েই আপনি ওজন কমাতে পারবেন। তার জন্য প্রথমে চাই মোটিভেশন ও সদিচ্ছা। হঠাৎ করে বা রাতারাতি ওজন কমানোর চেষ্টা করবেন না। দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা করুন। কেবল ওজন কমালেই চলবে না, সেই কম ওজন ধরে রাখাও চাই।
উচ্চতা অনুযায়ী আপনার আদর্শ ওজন কত হওয়া উচিত, তা আগে জেনে নিন। সেটা হলো আপনার লক্ষ্য। লক্ষ্য যদি খুব দূরে হয়, মানে আপনার ওজন অতিরিক্ত বেশি হয়, তবে প্রথমে ৫ শতাংশ ওজন কমানোর লক্ষ্য ঠিক করুন।
আদর্শ ওজন অনুযায়ী একটি ক্যালরি চার্ট বা খাদ্যতালিকা করে নিন। প্রতিদিনের ক্যালরি থেকে ৫০০ থেকে ৬০০ ক্যালরি কমিয়ে ফেললে ওজন কমতে শুরু করবে।
শুধু ক্যালরি কমালেই হবে না; খাবার বাছাই করতে হবে সযত্নে। জটিল ও আঁশযুক্ত শর্করা গ্রহণ করবেন গ্লুকোজের উৎস হিসেবে। ভালো মানের প্রোটিন খেতে হবে। রেড মিট কমিয়ে মাছ, মুরগি, ডাল, বীজ, ডিম, দুধ থেকে আমিষ নেওয়ার চেষ্টা করুন। ফ্যাট বা চর্বি গ্রহণ কমাতে হবে দৈনিক ২০ শতাংশ। সেই চর্বি অসম্পৃক্ত চর্বি বা ওমেগা ৩ সমৃদ্ধ হলে ভালো। সামুদ্রিক মাছ, বাদাম ইত্যাদিতে আছে এই ওমেগা ৩। সম্পৃক্ত চর্বি (ঘি, মাখন, ডালডা, মাংসের গায়ে লেগে থাকা চর্বি) বাদ দিতে হবে। উচ্চ ক্যালরিযুক্ত যেকোনো খাবার যেমন ফাস্ট ফুড, কোমল পানীয়, মিষ্টি, চকলেট, ট্রান্সফ্যাট বাদ দিতে হবে। দিনে অন্তত ৬ গ্রাম ফাইবার বা আঁশ গ্রহণ করতে হবে।
দীর্ঘদিন কম ওজন ধরে রাখার জন্য সুষম খাদ্যাভ্যাস সবচেয়ে ভালো। ভেরি লো ক্যালরি ডায়েট, লো কার্ব বা কিটো ইত্যাদি জনপ্রিয় ডায়েটে প্রাথমিকভাবে ওজন কমলেও ১২ থেকে ২৪ মাস পর মেটাবলিক, কার্ডিওভাসকুলার কোনো উপকার পাওয়া যায়নি। আর মনে রাখবেন, কেবল ডায়েটের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ওজন কমানোর প্রবণতা ধরে রাখা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে চাই ব্যায়াম।
প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ মিনিট বা সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট ব্যায়াম বা অ্যারোবিক এক্সারসাইজ করতে হবে। দ্রুত হাঁটা, জগিং, সাঁতার, সাইকেল চালনা ইত্যাদি হলো অ্যারোবিক ব্যায়াম।
ব্যায়ামের পাশাপাশি দৈনন্দিন প্রচেষ্টায়ও কিছু লাভ আছে। যেমন অফিসে কাজের ফাঁকে পায়চারি, বাগানে বা গৃহকর্মে অংশ নেওয়া, লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি ব্যবহার করা, গাড়ির বদলে হেঁটে বাজার করা ইত্যাদিতেও ক্যালরি ক্ষয় হয়। দৈনিক দশ হাজার পদক্ষেপ বা স্টেপস হাঁটাহাঁটির চেষ্টা করুন সব মিলিয়ে।