মানুষ কেন কোমায় চলে যায়
মানুষ কেন কেমায় চলে যায় সে সম্পর্কে প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন স্ট্রোক ও নিউরোইনটারভেনশনিস্ট নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শরীফ উদ্দীন খান।
কোমা হলো এমন একটি অবস্থা, যেখান থেকে মানুষ জেগে উঠতে পারে না বা তার চেতনা কাজ করে না। যখন কেউ পরিবেশের কোনো উদ্দীপনায় (যেমন শব্দ, আলো, ব্যথা ইত্যাদিতে) সাড়া দেয় না এবং তার ঘুম-জাগরণের কোনো চক্র আর অবশিষ্ট থাকে না, তখন সে কোমায় আছে বলে ধরা যায়। মস্তিষ্কের চূড়ান্ত পর্যায়ের ব্যর্থতা বা ফেইলিওরের উদাহরণ হলো এই কোমা।
সাধারণত কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কোমার একটি পরিসমাপ্তি ঘটে। হয় রোগী আবার জেগে ওঠে বা সচেতন হয়, নয়তো মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু বিরল ক্ষেত্রে কেউ কেউ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কোমায় থাকতে পারে।
কোমার কাছাকাছি দুটি শব্দ হলো ‘ব্রেইন ডেথ’ আর ‘ভেজিটেটিভ স্টেট’। ব্রেইন ডেথ অর্থ, মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি বা মস্তিষ্কের সব কার্যক্রম থেমে যাওয়া। আর ভেজিটেটিভ স্টেট অর্থ, রোগীর মস্তিষ্ক সজাগ থাকে, কিন্তু চেতনা দিয়ে বা স্বেচ্ছায় কিছু করতে পারে না।
কোমার কারণ
নানা ধরনের রোগ ও শারীরিক সমস্যার কারণে মানুষ কোমায় চলে যেতে পারে। যেমন: স্ট্রোক, মস্তিষ্কের টিউমার, মস্তিষ্কে হেমারেজ বা রক্তক্ষরণ, মস্তিষ্কে সংক্রমণ, এবসেস, থ্রম্বোসিস (রক্তনালি বা হৃদ্যন্ত্রে জমাট রক্ত) ইত্যাদি। আবার মস্তিষ্কের বাইরের কোনো সমস্যার কারণেও হতে পারে এটি। যেমন কোনো কারণে যদি মস্তিষ্কে হাইপোক্সিয়া বা অক্সিজেন সরবরাহের ঘাটতি থাকে (যেমন হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে), কিছু ওষুধ বা বিষের প্রতিক্রিয়ায়, শরীরে ইলেকট্রোলাইট বা খনিজ লবণের ভারসাম্যহীনতায় বা শরীরের তাপমাত্রা ও রক্তে শর্করা খুব বেশি বা কমে গেলে।
কী করতে হবে
কেউ অচেতন হয়ে পড়লে বা কোমায় চলে গেলে প্রথম কাজ হলো রিসাসিসেটশন বা জরুরি চিকিৎসা। সংক্ষেপে ‘এবিসি’ রক্ষা করা। ‘এ’ মানে এয়ারওয়ে বা শ্বাসনালি, ‘বি’ মানে ব্রিদিং বা শ্বাসপ্রশ্বাস আর ‘সি’ হলো সার্কুলেশন বা রক্তপ্রবাহ নিশ্চিত করা। যেকোনো মানুষ জ্ঞান বা চেতনা হারালে এবিসির মাধ্যমে তার শারীরিক মূল প্রক্রিয়াগুলো চালু করার চেষ্টা করতে হবে। বেসিক লাইফ সাপোর্ট বা সিপিআরে কাজ না হলে প্রয়োজনে অ্যাডভান্সড লাইফ সাপোর্ট দিতে হবে। অনেকেই এই জরুরি চিকিৎসায় চেতনা ফিরে পেতে পারে।
এরপরের কাজটি হলো কারণ অনুসন্ধান করা, কেন এমন হলো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। যেমন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার কারণে মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়া বা অতিরিক্ত বমি বা ডায়রিয়ার কারণে রক্তে ইলেকট্রোলাইট কমে যাওয়া, কিংবা একজন ডায়াবেটিসের রোগীর হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়ে যাওয়া। ইতিহাস ও শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে কারণ বের করা গেলে সে অনুযায়ী দ্রুত চিকিৎসা করা হলে রোগী কোমা থেকে উঠে আসতে পারে। যেমন: হাইপোগ্লাইসেমিক কোমার রোগীকে শিরায় গ্লুকোজ দেওয়া হলে বা ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালান্সের রোগীকে যথাযথ স্যালাইন দিলে তার জ্ঞান ফিরে আসবে। ইতিহাস স্পষ্ট না হলে রক্তের পরীক্ষা, ইসিজি, মাথার সিটি স্ক্যান বা এমআরআইসহ নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষার প্রয়োজন হবে আর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরবর্তী সময়ে কী হতে পারে
আগেই বলেছি, কারণ জানা গেলে আর দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত হলে অনেক রোগীই জ্ঞান বা চেতনা ফিরে পায় আর সুস্থ–স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে। আর তা যদি না হয়, তবে দুই রকম ঘটনা ঘটতে পারে। এক, অবস্থার আরও অবনতি ঘটে আর মৃত্যুবরণ করে। আর দুই, কেউ কেউ স্থায়ী ভেজিটেটিভ স্টেটে চলে যায়। এর মানে, তার রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন, শ্বাসপ্রশ্বাস ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঠিক থাকলেও সে আর কোনো দিন চেতনা বা জ্ঞান ফিরে পায় না। এই অবস্থায় রোগী দীর্ঘদিন থেকে যেতে পারে।
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের অনলাইনের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ভেজিটেটিভ স্টেটে থাকার রেকর্ড এলেইন এসপোসিটো নামের একটি মেয়ের, যিনি ১৯৪১ সালে একটি অস্ত্রোপচারের পর কোমায় চলে যান। সে অবস্থায় প্রায় ৩৭ বছর কাটিয়ে ১৯৭৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ধারণা করা হয়, অস্ত্রোপচারের সময় অ্যানেসথেসিয়া জটিলতায় মস্তিষ্কে হাইপোক্সিয়া হওয়ার কারণে তিনি আর জেগে ওঠেননি। তবে পরবর্তী সময়ে এডওয়ার্ডা ও’বারা নামের এক আমেরিকান নারী দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে ডায়াবেটিক কোমায় ছিলেন। দীর্ঘকালীন কোমা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিলেন ভারতীয় নার্স অরুণা শৌনবাগ। ১৯৭৩ সালে তিনি মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে একজন ওয়ার্ডবয় কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন আর স্থায়ী কোমায় চলে যান। দীর্ঘ ৩৭ বছর এ অবস্থায় থাকার পর ২০১১ সালে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে তাঁর পক্ষে ইউথেনেশিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন করেন একজন সাংবাদিক পিংকি ভিরানি। আদালত এই আবেদন নাকচ করে দিলেও ভারতে ইউথেনেশিয়া প্রথম চালু হয়। পরবর্তীকালে ৪২ বছর কোমায় থেকে এই নারী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২০১৫ সালে মারা যান।
কোমা প্রতিরোধে
যেসব কারণে মস্তিষ্কের এ ধরনের ব্যাপক বিপর্যস্ততা ঘটে, তার দ্রুত যথাযথ চিকিৎসা হলে কোমা প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমন ডায়াবেটিসের রোগীর হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে দ্রুত চিনি খাওয়া বা বমি ডায়রিয়ার কারণে লবণ কমে গেলে সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন খাওয়া বা শিরায় স্যালাইন দেওয়া। দুর্ঘটনা, মস্তিষ্কে আঘাত, বিষক্রিয়ার পর দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পর চিকিৎসা পেতে দেরি হলে প্রতি মুহূর্তে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই যেকোনো কারণে একজন মানুষ অচেতন বা অজ্ঞান হয়ে পড়লে যদি দ্রুততম সময়ে তাকে বেসিক লাইফ সাপোর্ট দেওয়া যায়, তবে এ ধরনের দুঃসহ পরিস্থিতি প্রতিরোধ করা সম্ভব।