শিশুদেরও হতে পারে হৃদ্রোগ
কেবল যে বড়দেরই হৃদ্রোগ হয়, তা নয়। শিশুরাও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হতে পারে। - সেসব সম্পর্কে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন এভারকেয়ার হাসপাতালের শিশু হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. তাহেরা নাজরীন।
জন্মগতভাবে শিশুদের হৃদ্পিণ্ডে ছিদ্র, রক্তনালি সরু, রক্তনালির ভাল্ব সরুসহ জটিল কিছু সমস্যা হতে পারে। জন্মের পরও শিশুর হার্টে সংক্রমণ বা জিনগত কিছু সমস্যা হতে পারে। এগুলো জন্মপরবর্তী সমস্যা। শিশুদের হৃদ্রোগে অভিভাবকদের সচেতনতা অনেক ভয়াবহ জটিলতা প্রতিরোধ করতে পারে। এসব রোগের উন্নত চিকিৎসা এখন দেশেই বিদ্যমান
জন্মগত হৃদ্রোগের লক্ষণ
- জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বা নীল হয়ে যাওয়া।
- মায়ের দুধ টেনে খেতে গেলে হাঁপিয়ে যাওয়া। একটু দুধ খেয়ে ছেড়ে দিয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার খাওয়া।
- দুধ খাওয়ার সময় কপাল ঘেমে যাওয়া।
- ঘন ঘন ঠান্ডা, কাশি বা নিউমোনিয়া হওয়া, যার কারণে ঘন ঘন হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে, কিন্তু পুরোপুরি রোগ সারছে না। সমস্যা লেগেই আছে।
- শিশুর ওজন কম বা ওজন না বাড়া।
- বুক ধড়ফড় করা বা বুকে ব্যথা।
- শিশুর ঠোঁট, জিহ্বা, ত্বক নীল হয়ে যাওয়া।
- দৌড়াতে গেলে শিশুটি হাঁটু গেড়ে বসে যদি হাঁপাতে থাকে আর শরীর নীল হয়ে যায় বা হঠাৎ অচেতন হয়ে যায়।
শিশুদের হার্টে ছিদ্র ও অন্যান্য জন্মগত হৃদ্রোগের চিকিৎসায় ওষুধ, যন্ত্র দিয়ে বা বেলুনিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা, প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করতে হতে পারে।
জন্মের পর হওয়া হৃদ্রোগ
জন্মপরবর্তী হৃদ্রোগের মধ্যে সাধারণত হার্টের সংক্রমণ বা জিনগত সমস্যা বেশি দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে—
- হার্টের মাংসপেশির সংক্রমণ হলে শিশুর জ্বরের সঙ্গে হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি হতে পারে। একে মায়োকার্ডাইটিস বলা হয়।
- জ্বরের সঙ্গে জয়েন্ট বা গিরায় গিরায় ব্যথা, বুকে ব্যথা, সাধারণত পাঁচ বছরের ওপরের বাচ্চার ক্ষেত্রে একে বাতজ্বর বলা হয়।
- শিশুদের মধ্যে সাধারণত পাঁচ বছর পর্যন্ত কাওয়াসাকি ডিজিজ দেখা যায়। এতে জ্বর (১০১-১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট), ত্বকে লালচে দানা বা রক্তের মতো ছোপ ছোপ দাগ, চোখ, জিহ্বা ও ঠোঁট লাল হয়ে যাওয়াসহ গলার দুপাশে ছোট গুটির (সারভাইকেল লিম্ফডেনোপ্যাথি) মতো দেখা যায়। কাওয়াসাকি ডিজিজে হার্টের রক্তনালি (করোনারি আর্টারি) ফুলে যায় যা ইকোকার্ডিওগ্রাফির মাধ্যমে বোঝা যায়।
শিশুদের করোনাজনিত হৃদ্রোগ
এমনিতে ধরে নেওয়া হয় যে শিশুদের ক্ষেত্রে করোনার সংক্রমণ অতটা বিপজ্জনক নয়। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর কিছু শিশু এমআইএসসি (মাল্টিসিস্টেম ইনফ্ল্যামেটরি সিনড্রোম) নামের একটি বিরল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এই রোগের সঙ্গে কাওয়াসাকি ডিজিজের মিল আছে। জন্ম থেকে একুশ বছরের শিশু–কিশোরেরা এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে যেসব শিশু আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের অভিভাবকদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
অধিক মাত্রার জ্বর, দুই-তিন দিনের ওপর স্থায়ী হয়। এ সময় ত্বকে লালচে দানা ওঠা; চোখ, ঠোঁট ও জিহ্বা লালচে হয়ে যাওয়া; পেটব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, বুকে ব্যথা, হার্টের বিট বেড়ে যাওয়া, রক্তের চাপ কমে যাওয়াসহ শিশুর অজ্ঞান হয়ে যাওয়া; শ্বাসকষ্ট, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া, শরীরের রং পরিবর্তন হওয়াসহ কিছুটা নীলচে ভাব দেখা দেওয়া—করোনা মহামারির সময় জ্বরের সঙ্গে এসব উপসর্গ দেখা দিলে সতর্ক হোন।
এমআইএসসি পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে শনাক্ত ও চিকিত্সা করলে মারাত্মক জটিলতা প্রতিরোধ করা যায়। কারণ এমআইএসসিতে বেশির ভাগ শিশুর হার্টের রক্তনালির পরিধি বড় হয়ে যায়। সময়মতো চিকিত্সা করলে রক্তনালির স্থায়ী পরিবর্তন (ফুলে যাওয়া, চিকন হয়ে যাওয়া বা রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালি বন্ধ হয়ে যাওয়া) প্রতিরোধ করা যায়।
বাংলাদেশে গত ১৫ মে তিন মাস বয়সী শিশুর এমআইএসসি রোগ শনাক্ত করা হয়। এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে দুটি তথ্যবিবরণ ইতিমধ্যে সিঙ্গাপুর জার্নাল অব কার্ডিওলজিতে প্রকাশিত হয়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এমআইএসসিতে আক্রান্ত শিশুদের, যারা অসুস্থতার সাত দিনের মধ্যে চিকিৎসা গ্রহণ করেছে, তাদের রোগপরবর্তী জটিলতা অনেক কম হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এসব শিশুর ফলোআপ অত্যন্ত জরুরি।
শিশুদের করোনা হয় না বা হলেও জটিলতা হয় না—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সকলের উচিত শিশুদের করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। দুই বছর বয়সের বেশি সব শিশুকে বাড়ির বাইরে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে শিশুকে দূরে রাখতে হবে। ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে চলুন। শিশুদের নিয়ে মার্কেট, জনসমাগম, উৎসব, হাসপাতালে যাওয়া যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। হাত বারবার সাবানপানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। শিশু ও শিশুর পোশাক, খেলনা এবং আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে মাস্ক ও শিল্ড পরে শিশুকে বুকের দুধ দিন ও পরিচর্যা করুন।