মনের রোগের চিকিৎসা
১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য’।
মনের রোগের জন্য কখন কাউন্সেলিং লাগবে, কখনইবা প্রয়োজন হবে ওষুধ কিংবা যেতে হবে হাসপাতালে—সেসব সম্পর্কে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আহমেদ হেলাল।
‘মনের রোগের জন্য আবার ওষুধ লাগে নাকি, কাউন্সেলিং করলেই চলবে!’ অথবা ‘মানসিক রোগের চিকিৎসায় কাউন্সেলিং কোনো কাজের না, ওষুধ তো চলছেই!’, কিংবা ‘মানসিক রোগের ওষুধ ভীষণ কড়া আর ভয়ংকর, অনেক সাইড অ্যাফেক্ট’ কিংবা ‘মানসিক রোগের ওষুধ মাত্রই ঘুমের ওষুধ’। এ রকম ধারণা বেশির ভাগ মনোরোগীর স্বজনদের।
নিজের বা স্বজনের মনের সমস্যার জন্য চিকিৎসা নিচ্ছেন, কিন্তু এ ধরনের মন্তব্য আর স্বপ্রণোদিত উপদেশ শোনেননি এমন মানুষ বিরল। একদিকে মানসিক স্বাস্থ্য আর রোগ নিয়েই রয়েছে নানা কুসংস্কার, তার ওপর এর চিকিৎসা নিয়েও বিভ্রান্তির শেষ নেই। বিভ্রান্তির এক প্রান্তে রয়েছে অপচিকিৎসা—পানিপড়া, তেলপড়া, কবচ, জাদুটোনা, ওঝার ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি। আরেক প্রান্তে রয়েছে মূলধারার চিকিৎসা নিয়ে অপপ্রচার। কখনো কখনো উচ্চশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, ধনী, গরিব, শহর, গ্রাম, নানা পেশার মানুষের মধ্যে মানসিক রোগের চিকিৎসা নিয়ে যে বিভ্রান্তি দেখা যায়, তা প্রকারান্তরে মানসিক রোগীর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। আর ক্ষতিটি বড় হয়ে যায় যখন রোগীরা কোনো আস্থাভাজন ব্যক্তির কাছ থেকেই এমনটা শুনে থাকেন।
এটাও কিন্তু রোগ
মনে রাখতে হবে, মানসিক রোগও কিন্তু ‘রোগ’। অন্যান্য রোগের মতোই এ রোগে মানুষের দেহে আর মনে পরিবর্তন ঘটে। আমাদের যেমন শরীর আছে, তেমনি মনও আছে। মনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে মানসিক প্রক্রিয়া বা মেন্টাল প্রসেস। চিন্তাশক্তি, অনুভব করা, স্মরণ রাখা, আবেগকে পরিচালিত করা—সবকিছুই কিন্তু মানসিক প্রক্রিয়া। আর এই মানসিক প্রক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক পদার্থ—যাকে বলা হয় নিউরোট্রান্সমিটার। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের নির্বাহী কাজ মিলেই আমাদের এসব মানসিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়।
মানসিক প্রক্রিয়াগুলোই আমাদের সব আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। কারও মানসিক রোগ হলে তাঁর নিউরোট্রান্সমিটারের ঘাটতি বা বাড়তিজনিত মানসিক প্রক্রিয়া, আবেগ আর আচরণের পরিবর্তন দেখা দেয়। এই জায়গাতেই ওষুধের কাজ। ওষুধ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য রক্ষা করে মানসিক রোগকে নিরাময় বা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মানসিক রোগ হওয়ার সঙ্গে নিউরোট্রান্সমিটারের ঘাটতি কিংবা বাড়তির পাশাপাশি সামাজিক ও বিকাশজনিত উপাদানও গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে মানসিক রোগের চিকিৎসায় সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিংয়ের গুরুত্বও কম নয়। ওষুধ যেমন একজন মানসিক রোগীর মস্তিষ্কের রাসায়নিক পদার্থের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে, তেমনি সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং তাঁর মনকে সুসংহত করার মাধ্যমে যৌক্তিক বিশ্বাস আর আচরণে উৎসাহিত করে।
প্রয়োজন সবার চেষ্টা
মানসিক রোগের চিকিৎসা একটি দলগত প্রচেষ্টা বা টিমওয়ার্ক। যাকে বলা হয় বায়ো-সাইকো-সোশ্যাল বা মনো-জৈব-সামাজিক পদ্ধতি। ওষুধ কাজ করে রাসায়নিক পদার্থ বা নিউরোট্রান্সমিটারের ওপর, সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং কাজ করে জ্ঞানীয় বিকাশ (কগনিশন), আচরণ ও মনের গড়নের ওপর। সেই সঙ্গে সামাজিক সহায়তা দেয় বাড়তি নিরাপত্তা আর বিশেষ প্রণোদনা। মানসিক রোগের চিকিৎসায় এই তিন প্রক্রিয়াই জরুরি। তবে রোগভেদে কোনো কোনো প্রক্রিয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে।
দুই ধরনের মানসিক রোগ
মোটা দাগে মানসিক রোগ দুই ধরনের। এক ধরনের মানসিক রোগে রোগী নিজেই বুঝতে পারেন, তাঁর কোনো মানসিক সমস্যা হচ্ছে, এ ধরনের রোগগুলো অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর। এ ধরনের রোগগুলোকে একসময় বলা হতো নিউরোসিস; যেমন মৃদু উদ্বিগ্নতা, মৃদু বিষণ্নতা, সম্পর্কের টানাপোড়েন ইত্যাদি। আরেক ধরনের মানসিক রোগে রোগী কখনো বুঝতেই পারেন না এবং স্বীকারও করেন না যে তাঁর কোনো মানসিক সমস্যা হচ্ছে। এই রোগগুলো খানিকটা গুরুতর, যাকে বলা হতো সাইকোসিস; যেমন সিজোফ্রেনিয়া, গুরুতর বিষণ্নতা, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার ইত্যাদি।
এই গুরুতর ধরনের মানসিক রোগ বা সাইকোসিসের চিকিৎসায় ওষুধের ভূমিকা অনেক বেশি। কারণ, এই রোগগুলোতে মস্তিষ্কের রাসায়নিক পদার্থের ভারসাম্য বেশি মাত্রায় নষ্ট হয়। তাই ওষুধ ছাড়া এ ধরনের রোগকে চিকিৎসা করা প্রায় অসম্ভব। আর ওষুধ দিয়ে একটি পর্যায়ে অবস্থার উন্নতি হলে কিছু বিশেষ সাইকোথেরাপি দেওয়া যেতে পারে।
আবার মৃদু মাত্রার মানসিক রোগ, যেখানে রোগী নিজের সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তনের কারণে মূলত মনের রোগটি হয়েছে—সেখানে তীব্র লক্ষণগুলো কমাতে কিছু ওষুধ দেওয়া হয় বটে, কিন্তু পাশাপাশি কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি অত্যন্ত কার্যকরী। যেমন এই গ্রুপের একটি রোগ অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি), যেটিতে দীর্ঘ সময় ওষুধও খেতে হয়, আবার প্রয়োজনীয় সাইকোথেরাপিও নিতে হয়।
সম্পর্কের জটিলতা, মানিয়ে চলার সমস্যা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব—এসব কারণে মনের ওপর চাপ তৈরি হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে মনের চাপ কমাতে সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং অগ্রগণ্য। কিন্তু যদি মনের চাপ থেকে নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা তৈরি হয়, তখন আবার ওষুধের প্রয়োজন হয়।
ওষুধ বা থেরাপি কত দিন
মানসিক রোগের ওষুধ কত দিন খেতে হবে, বা সাইকোথেরাপি কত দিন নিতে হবে, সেটা নিয়েও বিভ্রান্তির শেষ নেই। ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের রোগী ধরেই নিয়েছেন, তাঁর ওষুধ সহজে বন্ধ করা যাবে না, চোখের সমস্যা থাকা মানুষ ধরেই নিয়েছেন, তাঁর চশমা ছাড়া চলবে না। কিন্তু মানসিক রোগের ওষুধের ক্ষেত্রে এই মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রটি তৈরি হয়নি। বেশির ভাগ স্বজনের জিজ্ঞাসা, ‘ওষুধ কবে বন্ধ হবে?’—এর উত্তর হচ্ছে, মানসিক রোগের ওষুধ কখনো কখনো দীর্ঘ মেয়াদে সেবন করতে হয়। কিছু কিছু রোগের ক্ষেত্রে আজীবন। এ বিষয়ও মেনে নিতে হবে। চিকিৎসকেরাও বিষয়টি রোগীকে বুঝিয়ে বলবেন। সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিংয়ের ক্ষেত্রেও তাই দীর্ঘ সময় এই সেবা নিতে হয়। এক–দুটি সেশন করে বন্ধ করে দেওয়া চলবে না। সম্পূর্ণ চিকিৎসা সমাপ্ত না করলে লাভ নেই।
কিছু কিছু মানসিকে রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁরা ওষুধ খেতে চান না, স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণ করেন না, কারও নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা থাকে, কখনো কখনো আত্মহত্যার প্রবণতা বা চেষ্টাও দেখা দেয়। সেসব ক্ষেত্রে অবশ্যই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে। রোগী স্বেচ্ছায় ভর্তি হতে না চাইলে বিদ্যমান মানসিক স্বাস্থ্য আইন–২০১৮ অনুযায়ী অভিভাবকের সম্মতিতে অনিচ্ছুক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া যাবে।
মানসিক রোগের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে অহেতুক ভীতি রয়েছে। পৃথিবীর সব দেশেই মানসিক রোগের জন্য ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ওষুধ প্রয়োগের সময় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো জানিয়ে দেওয়াটা নিয়ম। আর চিকিৎসক ব্যতীত অন্যের কথায় হঠাৎ ওষুধ বন্ধ করে দিলে বিপদের ঝুঁকি দেখা দেয়। কখনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে বড় করে দেখার প্রবণতা রয়েছে, মনে রাখতে হবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মানে ওষুধের বিষক্রিয়া নয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে মেনে নিয়েই সব রোগের ওষুধ দেওয়া হয়। যেকোনো ওষুধের, এমনকি সাধারণ যে প্যারাসিটামল বা অ্যান্টিবায়োটিক সবাই দোকান থেকে নিজেরাই কিনে খান, তারও গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। মানসিক রোগের ওষুধে কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে মনে হলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওষুধ পরিবর্তন বা মাত্রা পরিমার্জন করে নিতে হবে। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। মানসিক রোগের ওষুধকে ভয় না পেয়ে রোগকে আমলে নিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যেতেই হবে।
মনোরোগের চিকিৎসায় মনে রাখতে হবে
- মানসিক রোগের চিকিৎসায় ওষুধের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ
- কিছু মানসিক রোগে ওষুধের পাশাপাশি সাইকোথেরাপিও প্রয়োজনীয়
- রোগের লক্ষণ গুরুতর হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, এমনকি রোগী অনিচ্ছুক হলেও
- চিকিৎসক ছাড়া অন্য কারও কথায় বা পরামর্শে ওষুধ বন্ধ করা বিপদের কারণ হতে পারে
- ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে ভয় না পেয়ে রোগকে নিরাময় বা নিয়ন্ত্রণের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে
- রোগী কোন ধরনের মানসিক রোগে ভুগছেন এবং সেটার চিকিৎসার গতিপ্রকৃতি কেমন হবে, সেটা জানা রোগী ও স্বজনের অধিকার। সেটা ব্যাখ্যা করা চিকিৎসকের পেশাগত দায়িত্ব। তাই প্রশ্ন করুন, জেনে নিন। পাড়াপ্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবের কথায় কান দেবেন না। নিজে জানার চেষ্টা করুন।
- মানসিক রোগ আর তার চিকিৎসা নিয়ে অহেতুক ভীতি ছড়াবেন না। এ ধরনের বেশির ভাগ রোগই নিয়ন্ত্রণযোগ্য, চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার থেকে রোগীকে বঞ্চিত করবেন না।