ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সমূহ
শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ফুসফুসের সাহায্যে আমরা অক্সিজেন গ্রহণ ও ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করে দিই। হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে ফুসফুসের সুষ্ঠুভাবে কাজ করা খুবই জরুরী। আজ ফুসফুস সুস্থ রাখা ও এর কার্যক্ষমতা বাড়ানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করব।
শ্বাস প্রশ্বাসের সময় নানা প্রকার ক্ষতিকর গ্যাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে যা দেহের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই এই দূষিত পরিবেশ যত তাড়াতাড়ি পরিহার করা যায়, ততই ভালো। আর এই গুরুত্বপুর্ণ কাজে সহায়তা করে এই ফুসফুস যার সাহায্যে আমরা শরীরে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন গ্রহণ ও শরীর থেকে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করে দিই। অঙ্গটিতে ডালপালার মতো অসংখ্য ছোট নালি রয়েছে যার মাধ্যমে নাকের ভেতর দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করা বাতাস হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আমাদের শরীরে হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের অবস্থান পাশাপাশি। তাই হৃৎপিণ্ডকে ভালো রাখার জন্য ফুসফুসেরও সুষ্ঠুভাবে কাজ করা অনেক জরুরি। এজন্য ফুসফুস সুস্থ রাখতে অনেক যত্নবান হতে হবে। ফুস্ফুসের কাজ ও এর কার্যক্ষমতা বাড়াতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে বিষয়ে আজ বিস্তারিত আলোচনা করব।
ফুসফুসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমূহ
একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রতি মিনিটে ১২-১৮ বার ও একজন শিশু ২০-৩০ বার শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়। তবে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে। আমাদের শ্বসনতন্ত্রের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নাম ফুসফুস যা ইংরেজিতে Lung নামে পরিচিত। এই অঙ্গের প্রধান কাজ হচ্ছে মানুষের রক্তে সৃষ্ট কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ করে বাইরের বাতাস থেকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সংগ্রহ করে শরীরের রক্তপ্রবাহে সরবরাহ করা। এছাড়া বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে ধ্বনি তৈরি করার জন্য মধ্যস্থদা-র চাপে প্রয়োজনানুসারে বাতাস সরবরাহ করাও এর অন্যতম কাজ। মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাঠাতেও ফুসফুস পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে।
ফুসফুসের বিভিন্ন সমস্যার কারণসমূহ
ফুসফুস জীবন রক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ। ইদানিং ফুসফুসের নানা সমস্যা অনেক বেড়ে গেছে। দ্রুত নগরায়নের ফলে বর্তমানে আমাদের ফুসফুসের বারোটা বাজতে বসেছে। যদিও একটি ফুসফুস নিয়ে বাঁচা সম্ভব তবে দুটি ফুসফুসই যদি রোগাক্রান্ত হয় তবে মৃত্যু অনিবার্য। প্রধানত দুটি কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, প্রথমত নানা ধরণের অসুখ বিসুখ ও দুর্ঘটনার কারণে এবং দ্বিতীয়ত জন্মগত অসুখের কারণে। অসুখ বিসুখ ও দুর্ঘটনার কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হবার বিভিন্ন পর্যায় নিম্নে দেওয়া হলো।
১। কারও যক্ষ্মা হলে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
২। মশার কয়েল থেকেও ফুসফুসের ভীষণ ক্ষতি হতে পারে।
৩। দুর্ঘটনা জনিত কারণে ফুসফুসে আঘাত পেলে এর ক্ষতি হতে পারে।
৪। বিভিন্ন খনি অঞ্চলে ফুসফুসের অসুখ বেশী হয়। কয়লা খনিতে কর্মরত শ্রমিকদের যক্ষ্মাসহ বিভিন্ন অসুখের ফলে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৫। কলকারখানা বা গাড়ির ধোঁয়াতে প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড থাকে যা ফুসফুসের জন্য অনেক বিপজ্জনক। এসব দূষিত পরিবেশ ফুসফুসকে ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ফুসফুস শক্তিশালী রাখার কয়েকটি প্রাকৃতিক উপায়
১। গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া:
শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ানোর অন্যতম উপায় হচ্ছে গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া যা সবচেয়ে সহজও। প্রতিদিন ‘ইয়োগা’ করাও এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে।
২। নিয়মিত শরীরচর্চা করা:
সব ধরনের শরীরচর্চাই শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষমতা বাড়ানো সহ ফুসফুসের জন্য অনেক উপকারী। এজন্য নিয়মিত সাঁতার কাটা, দৌড়ানো, ট্রেকিং ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে নিজেকে সংযুক্ত করা দরকার।
৩। প্রচুর পানি পান করা:
শরীরের বিভিন্ন প্রকার সমস্যার সমাধানে পানির ভুমিকা অপরিসীম। নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করলে শরীরে রক্ত চলাচল সুগম হয় এবং ফুসফুস আর্দ্র ও ভালো থাকে। তাই ফুসফুসকে ভালো রাখতে প্রচুর পানি পান করা উচিত।
৪। কড়া গন্ধযুক্ত খাবার (রসুন, পেঁয়াজ) খাওয়া
অনেকসময় বিরক্তিকর মনে হলেও কড়া গন্ধযুক্ত খাবার যেমন রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি খেলে দেহে তা কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে যা ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টিতে বাধা দেয়। তাই নিয়মিত এসব মশলাজাতীয় খাবার খাওয়া যেতে পারে।
৫। লেবুজাতীয় ফল খাওয়া
প্রতিদিন লেবুজাতীয় ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। এধরনের ফলে থাকে ভিটামিন “সি” যা ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহে সাহায্য করে।
৬। অন্যান্য খাবার খাওয়া
ক্যাপসিকামঃ ক্যাপসিকামে রক্ত সঞ্চালন এবং প্রদাহ থেকে রক্ষা করার সহায়ক উপাদান বিদ্যমান। তাই এ সবজিটি আমাদের খাদ্য তালিকায় রাখা যেতে পারে।
বাদাম: বাদাম ও বীজজাতীয় খাবারে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়া্ম থাকে যা ফুসফুসের স্বাস্থ্যকর কার্যাবলী অক্ষুণ্য রাখতে সহায়তা করে।
আদা: আদায় প্রদাহরোধী উপাদান থাকে যা ফুসফুস থেকে বিষাক্ত উপকরণ দূর করতে সাহায্য করে। তাই কাঁচা অথবা খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে এই আদা খাওয়া যেতে পারে।
কুমড়া ও গাজরঃ ভিটামিন সি যুক্ত কুমড়া ও গাজর ফুসফুসের রোগবালাই দূরে রাখতে ভুমিকা রাখে।
হলদি দুধ: প্রতি রাতে এক গ্লাস দুধে হলুদ মিশিয়ে খেলে ফুসফুসের প্রদাহ ও রোগবালাই অনেক দূরে থাকে।
ফুসফুস ভালো রাখতে যা যা করতে হবে
- ধূমপান শুধু ফুসফুস নয় পুরো দেহের জন্য অনেক ক্ষতিকর। ধূমপায়ীদের ফুসফুসে সিগারেটের ক্ষতিকর উপাদান 'নিকোটিন' নামের একটি উপাদান বছরের পর বছর জমতে থাকে। এর ফলে ক্রমান্বয়ে ফুসফুস বিশুদ্ধ বাতাস দেহে পাঠাতে পারে না। ধূমপায়ীদের ফুসফুসের অসুখ খুব বেশি হয়। তাই যাদের এই অভ্যাসটি আছে তাদের অবিলম্বে এই খারাপ অভ্যাসটি পরিহার করতে হবে।
- প্রকৃতিতে সবুজ গাছপালা বেশী থাকলে বাতাসে পর্যাপ্ত দূষণমুক্ত অক্সিজেন পাওয়া সম্ভব। তাই যেখানে ও যখন সম্ভব আমাদের বেশী বেশী গাছ লাগাতে উদ্যোগী হতে হবে। আমরা আমাদের বাড়ির ছাদে ফুলের টবে গাছ লাগিয়েও অনেক উপকার পেটে পারি।
- নিয়মিত ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি বাসার মধ্যে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকাটা ভীষণ জরুরি। এছাড়া আমাদের বাড়িঘর কলকারখানা, ইটভাটা, ট্যানারি যতটুকু সম্ভব দূরে নির্মান করা দরকার যার ফলে এসব থেকে বের হওয়া দূষিত ক্যামিকাল থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
- বাড়িঘর থেকে গুমোট অবস্থা দূর করতে হবে। আমাদের রান্নাঘর, টয়লেট বা গোয়ালঘর থেকে দূষিত গ্যাস বের হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটরেরর ব্যবস্থা থাকা জরুরী।
- মাঝে মাঝে লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে উঠা দরকার যার ফলে পুরো দেহে রক্ত সঞ্চালিত হবে। এতে হৃৎপিণ্ডের পাশাপাশি ফুসফুসেরও কার্যক্ষমতা বেড়ে যাবে।
- কারও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও দেহে অতিরিক্ত ওজন থাকলে সেগুলো অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
- পারিবারিকভাবে ফুসফুসের ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে আগে থেকেই সতর্ক হতে হবে।
- কারও যক্ষ্মা, হাঁপানি বা ফুসফুসের অন্য কোনো সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
ফুসফুসের কাজ অবিরাম চলতে থাকে, কখনোই যেন এর বিরাম নেই। এই সুন্দর পৃথিবীতে ভালোভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে ফুসফুসের সুস্থতা খুবই অপরিহার্য। তাই চলুন ফুসফুস সুরক্ষিত রাখতে একটি সুস্থ জীবনধারার অভ্যাস গড়ে তুলি এবং নিজের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নানান জটিলতা থেকে মুক্ত রাখি।