ফ্রিজে খাবার সংরক্ষণে কিছু জরুরী পরামর্শ
যেসব পরিবারে স্বামী ও স্ত্রী দু’জনেই চাকরি করেন সেসব পরিবারে তিনবেলা রান্না করা কঠিন। তাই বাধ্য হয়েই তাদের নির্ভর করতে হয় রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজের ওপর। চলুন জেনে নিই ফ্রিজে কোন খাবার কিভাবে, কত দিন ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত।
পরিবারে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে চাকরি করলে সেসব পরিবারে তিনবেলা রান্না করা অনেক কঠিন। তাই বাধ্য হয়েই তাদের নির্ভর করতে হয় রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজের ওপর। কিন্তু আমরা অনেকেই এর সঠিক ব্যবহার সন্মন্ধে জানি না। ফ্রিজে কোন খাবার কিভাবে, কত দিন রাখা যাবে? কোন জিনিস কত তাপমাত্রায় রাখতে হবে? এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভালোভাবে জেনে রাখা দরকার। ফ্রিজে কাঁচা খাবার রাখার পদ্ধতি এক রকম আর রান্না করা খাবার সংরক্ষণের পদ্ধতি অন্য রকম। সঠিক নিয়মে সংরক্ষণ না করলে খাবারের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায় এমনকি খাবার বিষাক্ত হয়ে যেতে পারে। আজ আমরা জানব খাবার কিভাবে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যায় সে বিষয়ে।
ফ্রিজের তাপমাত্রা কেমন হয়?
সাধারণত ফ্রিজ ডিপ ও নরমাল- এ দুই ভাগে বিভক্ত থাকে। ফ্রিজের নরমাল অংশের তাপমাত্রা সব সময় ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকা রাখতে হয় এবং ডিপ ফ্রিজের তাপমাত্রা ০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা-১৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেটের আশপাশে রাখা উচিত। ফ্রিজে আলাদা আলাদা তাপমাত্রায় খাবার রাখা উচিত। এজন্য অবশ্যই ফ্রিজের তাপমাত্রার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখা দরকার। খাবারের পরিমাণ অনুযায়ী প্রয়োজনে তাপমাত্রা কিছুটা কমাতে এবং বাড়িয়ে নিতে হবে। কাঁচা মাংস, মাছ ইত্যাদি ডিপ অংশে এবং সবজি, ফল ইত্যাদি নরমাল অংশে রাখা উচিত। আমরা অনেকেই ফ্রিজে খাবার বিশেষ করে মৌসুমি ফলমূল মাসের পর মাস ডিপ ফ্রিজে রেখে দেন এবং ভাবেন তা ঠিক থাকবে। ঠাণ্ডার কারণে হয়তো ব্যাকটেরিয়া ধীরে ধীরে কাজ করে। তাই ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে তা অবশ্যই গরম করে নিয়ে খেতে হবে। তাই বেশি দিন ফ্রিজে খাবার রাখা উচিত না। বক্সে করে ফ্রিজে খাবার রাখলে বক্সগুলোর মাঝে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে যাতে ভেতরে বাতাস চলাচল করতে পারে।
কোন খাবার ফ্রিজে কতদিন রাখা যাবে?
১। হট ডগ, পিৎজা, চিকেন প্যাটিস বা বার্গার জাতীয় খাবার খোলা অবস্থায় ১ সপ্তাহ, না খোলা অবস্থায় ২ সপ্তাহ পর্যন্ত রাখা যায়।
২। কাঁচা মাংস ফ্রিজে রাখলে ৩-৫ দিন ভালো থাকে। তবে কাঁচা মুরগির মাংস ডিপ ফ্রিজে আস্ত অবস্থায় রাখলে তা প্রায় ১ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। আর কাটা অবস্থায় ৫-৬ মাসের মধ্যে রান্না করে ফেলাই উত্তম।
৩। ফ্রিজে স্যুপ জাতীয় খাবার সাধারণত ৩-৪ দিন ভালো থাকে। রান্না করা মুরগির মাংস, মাছ বা ডিমের কোনো আইটেম ৩-৪ দিন পর্যন্ত ফ্রিজে রাখা যায়। শরীর ঠিক রাখতে এই গাইড লাইন মেনে চলা একান্ত প্রয়োজন।
কোন জাতীয় খাবারের জন্য ফ্রিজের কোন অংশ ব্যবহার করতে হবে?
১। কাঁচা মাছ ও মাংসঃ
সাধারণ কাঁচা মাছ ও মাংস রাখতে ফ্রিজের ডিপ অংশ ব্যবহার করা উচিত। কাঁচা মাছ, মাংস অবশ্যই ১ ডিগ্রির কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। কাঁচা মাছ, মাংস এবং পোলট্রি প্রডাক্ট বাকি খাবারের সঙ্গে রাখা যাবেনা কারণ অনেক সময় এগুলো থেকে পানি বের হয়। আর এই পানি বাকি খাবারে মিশে গিয়ে বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। ফ্রিজে মাংস রাখার আগে অবশ্যই সেগুলো ভালো করে ধুয়ে একদম পরিষ্কার করে নেওয়া উচিত। এর ফলে মাংসে বাজে গন্ধ হবে না এবং অনেকদিন পর্যন্ত সতেজ থাকবে, স্বাদ থাকবে অক্ষুণ্ণ।
২। ফল এবং সবজিঃ
ফ্রিজে রাখা মাত্র বিশেষ কিছু ফল যেমন কলা, জাম, নাশপাতি এবং টমেটোর শরীর থেকে ইথাইলিন গ্যাস বের হয়, যা টাটকা সবজিকে তাড়াতাড়ি নষ্ট করে দিতে পারে তাই এসব ফল ফ্রিজে না রাখাই ভালো। একইভাবে বিভিন্ন সবজির শরীর থেকেও ইথাইলিন গ্যাস বের হয় যেমন ব্রকলি, গাজর, শসা, বেগুন, মটরশুঁটি, লেটুস প্রভৃতি। ফ্রিজের গায়ের সঙ্গে লাগিয়ে বিশেষ করে কোনো রকমের তাজা ফলমূল বা সবজি একেবারেই রাখা ঠিক না। সবজি বা ফল এয়ার টাইট কনটেইনারেও রাখা যাবে না। সবজি পলিথিনের ব্যাগে না রেখে কাগজের প্যাকেটে কিংবা খবরের কাগজ দিয়ে মুড়ে রাখা যেতে পারে ফলে এগুলো অনেকদিন পর্যন্ত সতেজ থাকবে। অন্যান্য কিছু সবজি একটু ভিন্নভাবে রাখতে হয় যেমন : মরিচের বোঁটা ফেলে কাচের বয়ামের মধ্যে রাখলে তা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ভালো থাকে। এছাড়া শাক কুটে ও ধনে পাতা গোড়াসহ রাখলে ভালো থাকে। সংরক্ষণ উপযোগী মৌসুমি সবজি সিদ্ধ করার পর বিভিন্ন বক্সভর্তি করে ফ্রিজে রাখা যায়। এতে দীর্ঘদিন পর্যন্ত সবজিগুলোর গুণগতমান ভালো থাকবে। আর মৌসুম শেষে সেগুলো রান্না করে খাওয়া যাবে।
৩। ফলের রস, সস, জ্যাম, পানি ও ইনসুলিনঃ
দরজার একেবারে নিচের তাকে অর্থাৎ যেখানে তাপমাত্রা সব সময় ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকে সেখানে ফলের রস, সস, জ্যাম, পানি এবং ইনসুলিন জাতীয় ওষুধ রাখা উচিত।
৪। ঘি ও মাখন:
অনেকদিন ভালো রাখার জন্য ঘি ও মাখন ফ্রিজে রাখা যেতে পারে পারেন । তবে দুটি খাবারই একদম এয়ার টাইট পাত্রে রাখা দরকার।
৫। আইসক্রিম ও প্যাকেটজাত ফ্রোজেন ফুড:
আইসক্রিম ও প্যাকেটজাত ফ্রোজেন ফুড যেমন: রোল, সিঙ্গারা, সমুচা, পিঠা ইত্যাদি ফ্রিজে রাখার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। এগুলো ফ্রিজের ডিপ অংশে রাখা যাবে তবে তাপমাত্রার সামান্য হেরফেরে এই খাবার নষ্ট হয়ে যেতে পারে তাই এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকা দরকার।
৫। দুধ ও টক দইঃ
অল্প সময়ের জন্য দুধ রাখতে ফ্রিজের নিচের তাকে যেখানে তাপমাত্রা ১-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার কাছাকাছি রাখা বেশী উপযুক্ত। এখানে দুধ বা দই রেখে দেওয়ার পর খাওয়ার কমপক্ষে এক ঘণ্টা আগে বের করে নিলে দুধের গুণগত মান নষ্ট হয় না। তবে দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য টক দই ডিপ ফ্রিজে রাখা উচিত।
৬। রান্না করা খাবারঃ
রান্না করা খাবার ফ্রিজের নরমাল অংশের ওপরের তাকে রাখা যাবে। রান্না করা গরু, খাশি বা মুরগির মাংস, মাছ এবং সিদ্ধ ডিম ফ্রিজে ৩-৪ দিনের মধ্যে খেয়ে ফেলা উচিত। মনে রাখতে হবে রান্না করা খাবার কখনই ৪ দিনের বেশি ফ্রিজে রাখা ঠিক নয়।
৭। কাটা পেঁয়াজ ও বাটা মসলা
ফ্রিজে কাটা পেঁয়াজ রাখতে চাইলে পেঁয়াজ একটি এয়ার টাইট বক্সে রেখে সামান্য লবণ ছিটিয়ে দিতে হবে। তারপর বক্সটি মুখ বন্ধ করে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে নিতে হবে। এছাড়া বাটা মসলা ফ্রিজে রাখতে চাইলে তা বক্সভর্তি করে রাখা উচিত।
৮। ডিমঃ
বেশিরভাগ ফ্রিজেই ডিম রাখার জন্য আলাদা জায়গা থাকে। ফ্রিজে ডিম রাখার সময় মোটা অংশটি নিচের দিকে ও সরু অংশটি ওপরে রাখা ভালো। ডিম হাতলে না রেখে বাটিতে করে ফ্রিজের ভেতরে রাখা উচিত।
অনেকে একসঙ্গে অনেক মাংস সংগ্রহ করে বা কিনে দীর্ঘদিন ফ্রিজে রেখে দিতে পছন্দ করেন। ধীরে ধীরে সেই মাংস খান। একসঙ্গে বেশি খাবার রেখে দিলে রান্নার আগে কাঁচা মাছ বা মাংস পুরোটাই ভিজিয়ে রাখতে হয় রান্না করা খাবার একত্রে রাখলে বারবার পুরোটাই জ্বাল দিতে হয়। এতে করে খাবারের পুষ্টি ও স্বাদ দুটোই নষ্ট হয়। তাই খুব বেশি খাবার একসঙ্গে না রেখে প্রয়োজন অনুযায়ী ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে রাখা যেতে পারে। ফ্রিজে সর্বদা এক টুকরো কাটা লেবু রাখলে ও মাঝে মাঝে বেকিং সোডা মেশানো পানি দিয়ে ফ্রিজ মুছে নিলে এক খাবারের গন্ধ অন্য খাবারে প্রবেশ করবে না। ফলে ফ্রিজেও দুর্গন্ধ হবে না। তাই আসুন সবাই সঠিকভাবে ফ্রিজ ব্যাবহার করে খাদ্যমান ও ফ্রিজের দীর্ঘস্থায়ীত্ব নিশ্চিত করি।